১
এক তাঁতি, তার দুই স্ত্রী। দুই তাঁতি বউর দুই মেয়ে,- সুখু আর দুখু। তাঁতি বড় স্ত্রী আর বড় মেয়ে সুখুকে বেশি বেশি আদর করেন। বড় স্ত্রী বড় মেয়ে ঘর-সংসারের কুটাটুকু ছিঁড়িয়া দুইখানা করে না; কেবল বসিয়া বসিয়া খায়। দুখু আর তার মা সুতা কাটে, ঘর নিকোয়; দিনান্তে চারটি চারটি ভাত পায়, আর সকলের গঞ্জনা সয়।
একদিন তাঁতি মরিয়া গেল। অমনি বড় তাঁতি বউ তাঁতির কড়িপাতি যা ছিল সব লুকাইয়া ফেলিল, আপন মেয়ে নিয়া দুখু আর দুখুর মাকে ভিন্ন করিয়া দিল।
সুখুর মা আজ হাটের বড়মাছের মুড়াটা আনে, কাল হাটের বড় লাউটা আনে, রাঁধে, বাড়ে, সতিন সতিনের মেয়েকে দেখাইয়া দেখাইয়া খায়।
দুখুর মা আর দুখুর দিনে রাত্রে সুতা কাটিয়া কোনো দিন একখানা গামছা, কোন দিন একখানা ঠেঁটী, এই হয়। তাই বেচিয়া একবুড়ি পায়, দেড়বুড়ি পায়, তাই দিয়া মায়ে ঝিয়ে চারিটি অন্ন পেটে দেয়।
একদিন সুতা নাতা ইঁদুরে কাটে, তুলাটুকু নেতিয়ে যায়,-দুখুর মা, সুতা গোছা এলাইয়া দিয়া, তুলা ডালা রোদে দিয়া, ক্ষার কাপড়খানা নিয়া ঘাটে গিয়াছে। দুখু তুলা আগ্লাইয়া বসিয়া আছে। এমন সময় এক দমকা বাতাস আসিয়া দুখুর তুলাগুলা উড়াইয়া নিয়া গেল! একটু তুলাও দুখু ফিরাইতে পারিল না; শেষে দুখু কাঁদিয়া ফেলিল!
তখন বাতাস বলিল, 'দুখু কাঁদিস নে, আমার সঙ্গে আয়, তোকে তুলা দেব।' দুখু কাঁদিতে কাঁদিতে বাতাসের পিছু-পিছু গেল।
যাইতে যাইতে পথে এক গাই দুখুকে ডাকে, 'দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমার গোয়ালটা কাড়িয়া দিয়া যাবে?'
দুখু চোখের জল মুছিয়া, গাইয়ের গোয়াল কাড়িল, খড় জল দিল; দিয়া আবার বাতাসের পিছু চলিল।
খানিক দূর যাইতেই এক কলাগাছ বলিল, 'দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমায় বড় লতাপাতায় ঘিরিয়াছে, এগুলিকে টেনে দিয়ে যাবে?'
দুখু একটু থামিয়া কলাগাছের লতাপাতা ছিঁড়িয়া দিল।
আবার খানিক দূর যাইতে, এক সেওড়া গাছ ডাকিল,-'দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমার গুঁড়িটায় বড় জঞ্জাল, ঝাড় দিয়া যাবে?'
দুখু সেওড়ার গুঁড়ি ঝাড় দিল, তলার পাতাকূটা কুড়াইয়া ফেলিল। সব ফিট্ফাট্ করিয়া দিয়া, আবার দুখু বাতাসের সঙ্গে চলিল।
একটু দূরেই এক ঘোড়া বলিল- 'দুখু, দুখু, কোথা যাচ্ছ,- আমাকে চার গোছা ঘাস দিয়া যাবে?'
দুখু ঘোড়ার ঘাস দিল। তারপর চলিতে চলিতে দুখু বাতাসের সঙ্গে কোথায় দিয়া কোথায় দিয়া এক ধবধবে বাড়িতে গিয়া উপস্থিত!
বাড়িতে আর কেউ নাই; ফিটফাট ঘরদোর, ঝকঝক আঙিনা, কেবল দাওয়ার উপরে এক বুড়ি বসিয়া বসিয়া সুতা কাটিতেছে, সেই সুতায় চক্ষের পলকে পলকে জোড়ায় জোড়ায় শাড়ি হইতেছে।
বুড়ি আর কেউ না, চাঁদের মা বুড়ি! বাতাস বলিল,-'দুখু, বুড়ির কাছে গিয়া তুলা চাও, পাবে।'
দুখু গিয়া বুড়ির পায়ে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল, বলিল,-'দ্যাখ তো আয়ীমা, বাতাস আমার সব তুলা নিয়া আসিয়াছে-মা আমায় বক্বে আয়ীমা, আমার তুলা গুনে নিয়ে দাও।'
চুলগুলো যেন দুধের ফেনা, চাঁদের আলো; সেই চুল সরাইয়া চোখ তুলিয়া চাঁদের মা বুড়ি দেখে ছোট্ট খাট্ট মেয়েটি-চিনি হেন মিষ্টি-মধুর বুলি।
বুড়ি বলিল, 'আহা সোনার চাঁদ বেঁচে থাক। ওঘরে গামছা আছে, ওঘরে কাপড় আছে, ওঘরে তেল আছে, ঐ পুকুরে গিয়া দুটো ডুব দিয়া এসো; এসে ওঘরে গিয়া আগে চাট্টি খাও, তারপরে তুলা দেব এখন।'
ঘরে গিয়া দুখু- কত কত ভালো ভালো গামছা, কাপড় দেখে,-তা সব ঠেলিয়া, যা তা ছেঁড়া নাতা গামছা কাপড় নিয়া, যেমন-তেমন একটু তেল মাথায় ছোঁয়াইয়া, এক চিমটি ক্ষার খৈল নিয়া নাইতে গেল।
ক্ষার খৈল টুকু মাখিয়া জলে নামিয়া দুখু ডুব দিল। ডুব দিতেই এক ডুবে দুখুর সৌন্দর্য উথলে পড়ে!-সে কি রূপ!- অত রূপ দেবকন্যারও নাই!-দুখু তা’ জানিতেও পারিল না। আর একডুবে দুখুর গয়না, গায়ে ধরে না, পায়ে ধরে না। সোনাঢাকা অঙ্গ নিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া আসিয়া দুখু খাবার ঘরে গেল।
খাবার ঘরে কত জিনিস, দুখু কি জানে? জন্মেও অত সব দেখে নাই! এক কোণে বসিয়া দুখু চারটি পান্তা খাইয়া আসিল। চাঁদের মা বুড়ি বলিল, -“আমার সোনার বাছা এসেছিস!-ঐ ঘরে যা, পেঁটরায় তুলা আছে, নাও গে!”
দুখু গিয়া দেখিল,-পেঁটরার উপর পেঁটরা- ছোট, বড়, ক-ত রকমের! দুখু এক পাশের ছোট্ট এতটুকু এক খেলনা-পেঁটরা নিয়া বুড়ির কাছে দিল।
বুড়ি বলিল,-“আমার মানিক ধন! আমার কাছে কেন, এখন মা’র কাছে যাও, এই পেঁটরায় তুলা দিয়াছি।”
বুড়ির পায়ের ধূলা নিয়া পেঁটরা কাঁখে, রূপে, গয়নায়, পথ ঘাট আলো করিয়া দুখু বাড়ি চলিল। পথে ঘোড়া বলিল,-“দুখু দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” ঘোড়া খুব তেজী এক পক্ষীরাজ বাচ্চা দিল।
সেওড়া গাছ বলিল,-“দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” সেওড়া গাছ এক ঘড়া মোহর দিল।
কলাগাছ বলিল,-“দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” কলাগাছ মস্ত এক ছড়া সোনার কলা দিল।
গাই বলিল,- “দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” গাই এক কপিলা-লক্ষণ বক্না দিল। ঘোড়ার বাচ্চার পিঠে ঘড়া, ছড়া, তুলিয়া, বক্না নিয়া দুখু বাড়ি আসিল।
“দুখু, দুখু, ও পোড়ারমুখী- তুলা নিয়া কোথায় গেলি?-” ডাকিয়া, ডুকিয়া, আনাচে কানাচে, খানা জঙ্গল খুঁজিয়া, মেয়ে না পাইয়া দুখুর মা অস্থির-দুখুর মা ছুটিয়া আসিল, “ও মা, মা আমার, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?”-আসিয়া দেখে,-“ও মা! এ কি অন্ধের নড়ি দুঃখিনীর মেয়ে এ সব তুই কোথায় পেলি!”-মা গিয়া দুখুকে বুকে নিল।
মাকে দুখু সব কথা বলিল; শুনিয়া দুখুর মা মনের আনন্দে দুখুকে নিয়া সুখুর মা’র কাছে গেল,-“দিদি, দিদি,- ও সুখু, সুখু, আমাদের দুঃখ ঘুচেছে, চাঁদের মা বুড়ি দুখুকে এই সব দিয়াছে। সুখু কতক নাও, দুখুর কতক থাক।”
চোখ টানিয়া মুখ বাঁকাইয়া-তিন ঝক্না ভিরকুট্টি, সুখুর মা বলিল, -“বালাই! পরের কড়ির ভাগ-বাঁটরি-তার কপালে খ্যাংরা মারি! ধুইয়া খা।”
মনে মনে সুখুর মা বিড়্ বিড়্-“শত্তুরের কপালে আগুন,-কেন, আমার সুখু কি জলে ভাসা মেয়ে? দরদ দেখে মরে যাই! কপালে থাকে তো, সুখু আমার কালই আপনি ইন্দ্রের ঐশ্বর্য লুটে আনবে।” মুখ খাইয়া দুখু দুখুর মা ফিরিয়া আসিল।
রাত্রে পেঁটরা খুলিতেই দুখুর রাজপুত্র-বর বাহির হইল। রাজপুত্র-বর ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ায়, কপিলার দুধে আঁচায়,-দুখু, দুখুর মা,র ঘর-কুঁড়ে আলো হইয়া গেল।
-
২
রা নাই, শব্দ নাই, সুখুর মা সামনের দুয়ারে খিল দিয়াছে। পরদিন সুখুর মা পিছন দুয়ারে তুলা রোদে দিয়া ‘পিস্পিস্’ ‘ফিস্ফিস্’ সুখুকে বসাইয়া ক্ষার কাপড়ে পুঁটলি বাঁধিয়া ঘাটে গেল।
কতক্ষণ পর বাতাস আসিয়া সুখুর তুলা উড়াইয়া নেয়, কুটিকুটি সুখু,-বাতাসের পিছু পিছু ছুটিল!
সেই গাই ডাকিল, 'সুখু, কোথা যাচ্ছ শুনে যাও।'
সুখু ফিরিয়াও দেখিল না। কলাগাছ, সেওড়া গাছ, ঘোড়া সকলেই ডাকিল, দুখু কাহারও কথা কানে তুলিল না। সুখু আরো রাগিয়া গিয়া গালি পাড়ে, 'উঁ! আমি যাবো চাঁদের মা বুড়ির বাড়ি, তোমাদের কথা শুনতে বসি!'
বাতাসের সাথে সাথে সুখু চাঁদের মা বুড়ির বাড়ি গেল। গিয়াই, 'ও বুড়ি, বুড়ি, বসে’ বসে’ কি কচ্ছিস? আমায় আগে সব জিনিস দিয়ে নে, তার পর সুতো কাটিস। হুঁ! উনুনমুখী দুখু, তা’কেই আবার এত সব দিয়েছেন!' বলিয়া, সুখু, বুড়ির চরকা মরকা টানিয়া ভাঙ্গে আর কি!
চাঁদের মা বুড়ি অবাক।–“রাখ্ রাখ্”-ওমা! এতটুকু মেয়ে তার কাঠ কাঠ কথা, উড়ুনচণ্ডে’ কাণ্ড! বুড়ি চুপ করিয়া রহিল; তারপর বলিল, -“আচ্ছা, নেয়ে খেয়ে নে, তারপর সব পাবি।”
বলতে সয় না, সুখু দুড়্দাড়্ করিয়া এ ঘর থেকে’ সব্বার ভাল গামছা খানা, ওঘরে থেকে, সব্বার ভাল শাড়ি খানা, সুবাস তেলের হাঁড়ি চন্দনের বাটি যত কিছু নিয়া ঘাটে গেল।
সাতবার করিয়া তেল মাখে, সাতবার করিয়া মাথা ঘষে, ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,-সাতবার করিয়া আর্শি ধরিয়া মুখ দেখে,- তবু সুখুর মনের মত হয় না। তিন প্রহর ধরিয়া এই রকম করিয়া শেষে সুখু জলে নামিল।
এক ডুবে সৌন্দর্য! এক ডুবে গহনা!!-আঃ!!!- আর সুখুকে পায় কে? সুখু এদিকে চায়, সুখু ওদিকে চায়, “যত যত ডুব দিব, না জানি আরো কি পাব!”
“আঁই-আঁই-আঁই!!!”- তিন ডুব দিয়া উঠিয়া সুখু দেখে,-গা-ভরা আঁচিল, ঘা পাঁচড়া-এ-ই নখ, শোণের গোছা চুল-কত কদর্য সুখুর কপালে!- “ওঁ মাঁ, মাঁ গোঁ!-কিঁ হঁল গোঁ”-কাঁদিতে কাঁদিতে সুখু বুড়ির কাছে গেল।
দেখিয়া বুড়ি বলিল,-“আহা আহা ছাইকপালি,- তিন ডুব দিয়াছিলি বুঝি?-যা, কাঁদিসনে যা;- বেলা ব’য়ে গেছে, খেয়ে দেয়ে নে!”
বুড়িকে গালি পাড়িতে পাড়িতে সুখু, খাবার ঘরে গিয়া পায়েস পিঠা ভাল ভাল সব খাবার খাবলে খাবলে খাইয়া ছড়াইয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিল-“আচ্ছা বুড়ি, মাঁর কাঁছে আঁগে যাঁই!-দেঁ তুঁই পেঁটরা দিঁবি কিঁ না দেঁ।”
বুড়ি পেঁটবার ঘর দেখাইয়া দিল। য-ত বড় পারিল, এ-ই মস্ত এক পেঁটরা মাথায় করিয়া সুখু বিড়্ বিড়্ করিয়া চৌদ্দ বুড়ির মুণ্ডু খাইতে খাইতে রূপে দিক্ চম্কাইয়া বাড়ি চলিল!
সুখুর রূপ দেখিয়া শিয়াল পালায়, পথের মানুষ মূর্ছা যায়। পথে ঘোড়া এক লাথি মারিল; সুখু করে-“আঁই আঁই!” সেওড়া গাছের এক ডাল মটাস করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, সুখু করে-“মঁলাম! মঁলাম!” কলাগাছের এক কাঁদি কলা ছিঁড়িয়া পিঠে পড়িল; সুখু বলে- “গেঁলাম! গেঁলাম!” শিং বাঁকা করিয়া, গাই তাড়া করিল, ছুটিতে ছুটিতে হাঁপাইয়া আসিয়া সুখু বাড়িতে উঠিল।
দুয়ারে আলপনা দিয়া, ঘট পল্লব বিয়া জোড়া পিঁড়ি সাজাইয়া সুখুর মা বসিয়া ছিল। বারে বারে পথ চায়-
সুখুকে দেখিয়া, সুখুর মা “ও মা! মা! ও মা গো, কি হবে গো! কোথায় যাব গো!”
চোখের তারা কপালে, আছাড় খাইয়া পড়িয়া সুখুর মা মূর্ছা গেল। উঠিয়া সুখুর মা বলে,- “হ’ক হ’ক অভাগী, পেঁটরা নিয়ে ঘরে তোল্; দ্যাখ আগে, বর এলে বা সব ভাল হইবে!”
দুইজনে পেঁটরা নিয়া ঘরে তুলিল। রাত্রে পেঁটরা খুলিয়া, সুখুর বর বাহির হইল!- সুখু বলে,-“মা, পা কেন কন্ কন্?”
মা বলিল,-“মল পর।”
সুখু-“মা, গা কেন ছন্ ছন্?”
মা-“মা, গয়না পর।”
তারপর সুখুর হাত কট কট, গলা ঘড় ঘড়, মাথা কচ কচ ক-ত করিল,- সুখু হার পরিল, নথ নোলক, সিঁথি পরিয়া টরিয়া সুখু চুপ করিল। মনের আনন্দে, সুখুর মা ঘুমাইতে গেল।
পরদিন সুখু আর দোর খোলে না, “কেন লো,-কত বেলা, উঠবি না?”
নাঃ, নাওয়ার খাওয়ার বেলা হইল, সুখু উঠে না। সুখুর মা গিয়া কবাট খুলিল।– “ও মা রে মা!”-সুখু নাই, সুখুর চিহ্ন নাই-ঘরের মেজেতে হাড় গোড়, অজগরের খোলস!- অজগরে সুখুকে খাইয়া গিয়াছে!!- চেলাকাঠ মাথায় মারিয়া সুখুর মা মরিয়া গেল।