কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক তৈয়ব আখন্দ। একেবারে মাটির মানুষ। এটেল মাটি না, দোআঁশ মাটিও না। পলি মাটি।
বাড়ির পেছনে এক টুকরা জমি আছে। অবসরে বাগান করেন। বাগানটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি।
তৈয়ব আখন্দ আগাছা পরিষ্কার করেন না। ফাঁক-ফোকরে গাছ লাগান। ছাত্র-ছাত্রীদের বলেন-
- এটাকে বলে পারমাকালচার। আমরা যেভাবে চাষবাস করি সেটা ভালো না। মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, প্রকৃতি নষ্ট করে। পারমাকালচার হলো সবাই মিলে শান্তিতে থাকার মতো। প্রকৃতিতে কিছু ঝোপঝাড়, আগাছারও দরকার আছে।
এমনটা বলার একটা কারণও আছে। সেটা তৈয়ব আখন্দ ক্লাসে বলেননি। বললে ছেলেমেয়েরা ভয় পাবে, কিংবা তাকে পাগল মনে করবে।
তৈয়ব আখন্দ তার বাগানের ছোটোখাটো গাছপালার কথা বুঝতে পারেন, তাদের সঙ্গে প্রায়ই টুকটাক কথাবার্তা হয় তার।-
অনেক দিন আগের কথা। বাগানে বাঁধাকপির চারা লাগাবেন বলে মাটি পরিষ্কার করছিলেন তৈয়ব।
জমিতে নেমে একটা ভাঁটফুলের ঝোপ উপড়ে ফেললেন। উহ শব্দ করে উঠল গাছটা।
- কে? ভাঁটফুল নাকি?
- জি স্যার।
- তুই কথা বলছিস কেন?
বলেই ভুল বুঝতে পারলেন তৈয়ব। মিষ্টি কুমড়ার চারা হলে ‘তুই’ করে বলতেন না তিনি। ভাঁটফুল কি একেবারে ফেলনা?
- তুমি এখানে কী করো? আমি সবজির চারা লাগাব।
ভাঁটফুলের চারাটা বলল,
- স্যার, আমার সঙ্গেই লাগান। আমি বাঁধাকপির চারাগুলো দেখে রাখব। আমি আপনার বাগানের কেয়ারটেকার।
- অ্যাঁ!
- স্যার আমাদের জ্ঞান অপরিসীম। আমাদের শিকড় থেকে শিকড়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে জানি। আপনার সবজি চারার যাবতীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে। মাটিও ঠিকঠাক থাকবে। আপনি হয়তো জানেন না যে আমি কিন্তু চর্মরোগের মহৌষধ।
মনে হবে যেন জীবন বাঁচাতে হড়বড় করে কথাগুলো বলল গাছটা। কিন্তু তৈয়ব জানেন, কথা সত্য।
তৈয়ব আখন্দ আবার গাছটা মাটিতে লাগিয়ে দিলেন। ঝাঁঝরি দিয়ে পানিও দিলেন। এরপর পরিষ্কার শুনলেন, ভাঁটফুল গাছটা ‘আহ’ জাতীয় শব্দ করল।
নিজের মাথা ঠিক আছে কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য সেদিন রাতে তৈয়ব আখন্দ কঠিন দেখে দুটি গসাগুর অঙ্ক করলেন। অঙ্ক মিলেছে। তার মানে মাথাও ঠিক আছে।
-এরপর প্রায়ই বাগানের গাছগাছালির সঙ্গে তৈয়বের কথা হয়। তবে সেটা কাউকে বুঝতে দেন না।
এতে একটা লাভ হয়েছে। গাছের গোড়ায় সার দেওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না তৈয়ব আখন্দকে। অন্য গাছগুলো এদিক-ওদিক থেকে সব ম্যানেজ করে।
তৈয়বের বাগানে দিনে দিনে গাছ-গাছালি বাড়তে থাকে। কোথা থেকে পাখিরাও এসে বীজটিজ ছিটিয়ে দিয়ে যায়।
তৈয়বও বুঝতে পারেন গাছের সঙ্গে বক বক করতে গিয়ে তার মাথায় কিছু একটা ঢুকেছে। ভালো কিছু। সেটা কী?
তৈয়ব যেকোনো গাছের দিকে তাকালেই বুঝতে পারেন কোন গাছের কী গুণ। কোন পাতার সঙ্গে কোন ফুলের রস মেশালে কোন রোগ সারবে, সেটাও জানেন। তার এই কবিরাজি গুণের কথা খুব বেশি লোক জানে না।
কয়েক দিন আগে রায়বাবুর ছেলেটার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। তৈয়ব তাকে পাঁচ রকমের পাতার একটা রস খাইয়ে দিলেন। রাত পোহাতেই সুস্থ। কারও সামান্য হাত-পা ছিলে গেলে অবশ্য দু-চারটি জার্মানি লতা বেটে লাগালেই ঠিক হয়ে যায়।
এ সবই হয় গোপনে। বেশি লোকজন জানতে পারলে হইচই করবে। হইচই তৈয়বের মোটেও পছন্দ না।
- তৈয়ব, তোমার ওষুধে তো আমার বড় পোলার পায়ের ঘা সাইরা গেছে। তুমি তো বিরাট কবিরাজ।
গ্রামের ক্ষমতাধর মন্টু ব্যাপারীকে দেখে মুষড়ে গেলেন তৈয়ব আখন্দ। কয়েক দিন আগে এসেছিল ছেলের জন্য ওষুধ নিতে। আজ এসেছে তৈয়বের বাগান দখল করার মতলব নিয়ে।
- তোমাকে বললাম পেছনের জমিটা আমার। আমার দাদা তোমার বাবার কাছে এটা বিক্রি করলেও ওই দলিলে ঝামেলা আছে। মামলা মোকদ্দমার ব্যাপার। তোমারে কিছু টাকা দিই, জমি আমার নামে ট্রান্সফার করে দাও।
তৈয়ব ঘটনা আগেই জানত। তার বাগানে একটি রেডিও টাইপের গাছ আছে। সুদূর আমাজন থেকে তার বীজ এনে দিয়েছিল একটি পাখি। সেই গাছের দারুণ ক্ষমতা। ওই গাছটাই তৈয়বকে গত সপ্তাহে বলেছিল-
- স্যার, আলামত সুবিধার নয়। মন্টু ব্যাপারী আপনার জমি দখল করবে।
- করলে করবে। আমি অতি সামান্য মানুষ। ঠেকাতে পারব না।
- এই জমি সে একটি ওষুধ কোম্পানির কাছে বেচবে। ওরা আমাদের সবাইকে কেটেকুটে গবেষণা করবে। তারপর যখন কিছুই বুঝবে না তখন আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে।
- আমাকে কেন!
- স্যার, মানুষ দেখে লতাপাতা। ফর্মুলা তো আপনার মাথায়।
-মন্টু ব্যাপারী সেদিন হুমকি-ধমকি দিয়ে চলে গেলেন। তৈয়ব সারাদিন দুশ্চিন্তা করলেন। বেশি দুশ্চিন্তা হলে তিনি চলে যান বাগানে। তাকে দেখে একটা হাতিশুঁড় গাছ বলল-
- স্যার, মন খারাপের দুই ডোজ ওষুধ বানান। ফুরফুরা লাগব।
- ওষুধে কাজ হইব না।
পাশ থেকে গন্ধভাদালি লতাটা বলল-
- স্যার আপনি বিরাট রসায়ন বিজ্ঞানী। ভাবেন। সমাধান বের হবে।
- ঠিক আছে ভাবি।
ভাবতে ভাবতে তৈয়ব আখন্দ সমাধান পেলেন।
গভীর রাতে বের হলেন তৈয়ব। কিছু গাছগাছালি লাগবে। সব গাছ তার বাগানে নেই।
সবার আগে গেলেন মিশুদের উঠানে। কুড়িয়ে নিলেন কিছু মেহগনির বীজ। তারপর নিলেন বকফুল, পরশপিপুল, অশ্বগন্ধা, অনন্তমূল, ডুগডুগিসহ ১০ রকমের লতাপাতা। নিজের বাগান থেকে নিলেন আমাজন থেকে উড়ে আসা একটি গাছের শিকড়।
সব মিশিয়ে তৈরি করলেন একটা মিক্সচার। স্বাদ অনেকটা আচারের মতো। চেখে দেখলেন। খেতে ভালোই। এখন অপেক্ষার পালা।
-দুদিন পরই এলেন মন্টু ব্যাপারী। তৈয়ব এবার তাকে আপ্যায়ন করলেন। ভাত-ডালের সঙ্গে নিজের বাগানের তাজা সবজির তরকারিও দিলেন। মন্টু খুব খুশি। যাক জমিটা তাহলে তার কবজায় আসছে।
- মন্টু সাহেব আচার নেন। নিজের হাতে বানানো ভেষজ আচার।
- অবশ্যই খাব! তোমার হাতে তো জাদু আছে। দাও দাও।
আচার মুখে দিলেন মন্টু মিয়া।
- আহা! মনটা জুড়ে গেল। আরো দাও।
- আচারের ডোজ, ইয়ে মানে পরিমাণমতো খেতে হবে।
- কী যে বলো! এত স্বাদের জিনিস মেপে খেতে পারব না। আরও দুই চামচ দাও।
- আচ্ছা নেন।
প্রায় পুরো মিক্সচারটা সাবাড় করে দিলেন মন্টু। ঘটনা ঘটতে বেশিক্ষণ লাগল না। ঘণ্টাখানেক পর বললেন-
- কেমন ফুরফুরা লাগতাছে তৈয়ব। কত দিন পর মনে হইল তৃপ্তি কইরা ভাত খাইলাম।
- আপনি কি আমার জমিটা...।
- দুর! কী যে বলো। মানুষ কি সব সময় খারাপ থাকে? আমিও ঠিক করেছি ভালো হয়ে যাব। ভালো মানুষ কেমনে হয় জানো নাকি? আচ্ছা। আমি দেখি চেষ্টা করে।
তৈয়ব বুঝতে পারলেন ওষুধে কাজ হয়েছে। মিক্সচারটা ছিল ভালো মানুষ বানানোর ওষুধ।
পরদিন সকালে হইচই শুনে ঘুম ভাঙল তৈয়বের।
পাড়ার উঠানে বিশাল জমায়েত। মাঝখানে মন্টু ব্যাপারী। তার সামনে কয়েক শ গাছের চারা। মন্টু বলছেন-
- ভাইসব। আমি ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টায় আছি। ভালো কাজ কীভাবে করতে হয় আমার জানা নাই। তবে গ্রামবাসীর সহযোগিতা...।
ভিড় থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল-
- চারা কি আমাদের দিবেন? দিলে জলদি দেন। এত কথা কন ক্যান। সঙ্গে কিছু টেকা দিবেন? নাকি শুধু চারা?
- জি জনাব। আপনাদের জন্য। নিয়া যান। চারার সঙ্গে নগদ ১০০ টাকাও আছে।
এরপর মন্টু ব্যাপারীকে কথা বলার সুযোগ দিল না কেউ। হুড়মুড় করে সবাই চারা আর টাকা নিয়ে চলে গেল যার যার কাজে।
এগিয়ে গেলেন তৈয়ব।
- মন্টু ভাই, ভালো কাজ করাটা ধৈর্যের ব্যাপার। আড়ালে আবডালে করেন। কেউ টের না পাইলেই ভালো।
এরপর? এরপর একদিন মন্টু ব্যাপারী তৈয়বকে ফিসফিস করে বললেন-
- একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটছে তৈয়ব! তোমার বাগানের একটা নিশিন্দা গাছ আমারে কয়, মন্টু ভাই শরীর ভালো?