বিশাল আর সুন্দর এক বাগান। কতশত ফুল সেখানে তার গোনাগুনতি নেই যেন। কোথাও ফুটেছে রজনী গন্ধা, কোথাওবা চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ, কোথাও আবার হাসনাহেনার একটা ঝাড়। আরও যে কত ফুল সে বাগানে ফোটে তার কোনো লেখাজোখা নেই। বাগানের এত সুন্দর বাহারি ফুলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই গোলাপগাছটিকে, যেটাতে ফুটে আছে লাল টুকটুকে গোলাপ। সারা বছর এত সুন্দর গোলাপ ফোটে যে- যে দেখে সে-ই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এই গোলাপ গাছটির ঠিক নিচে গর্তে থাকে একটি শামুক। ইয়া মোটা খোল- সে খোলের ভেতর রয়েছে তার থলথলে শরীর। একদিন ভোরবেলা হাই তুলতে তুলতে শামুক তার খোলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সুড়সুড় করে। গোলাপ গাছকে ডেকে বলল, ‘কী হে ভায়া, করছ কী? কাজকর্ম কিছু নেই বলে কেবল ফুলই ফুটিয়ে যাচ্ছ? ভালো কাজ করতে চাও তো আমার মতো আস্তে আস্তে কাজ করতে শেখ!’
শামুক বলতে লাগল, ‘ভবিষ্যতে আমি যত বড় কাজ করব, তেমন কাজ কি তুমি কখনও করতে পারবে?’
গোলাপগাছ মাথা নুয়ে সম্মান জানালো শামুককে। বলল, ‘সে তো বটেই, আপনি কত বয়োজ্যেষ্ঠ, কত জানেন! আপনার কাছ থেকেই তো আমরা এমন কাজই আশা করি। তা কবে সেই বড় কাজটি করবেন?’
শামুক বলল, ‘কবে কখন হবে, অত ভাববার দরকার কী? তোমার যত তাড়াহুড়ো। সেই জন্যেই তুমি কোনো বড় কাজ করতে পারো না!’
কথাটা বলেই শামুক তার কালো রঙের শক্ত খোলের ভেতর ঢুকে পড়ল। সেই যে ঢুকল, এক বছরের মধ্যে আর বের হলোই না। সারা বছর কোনো কাজই করা হলো না। শুধু গোলাপগাছের নিচে এক জায়গায় শুয়ে ঘুমিয়ে কাটাল।
নতুন বছর এলো। নতুন বছরের ভোরে শামুক তার খোলের ভেতর থেকে হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে গোলাপগাছকে ডেকে বলল, ‘কী হে গোলাপ? বলি বুড়ো হতে চললে যে! সারা বছরজুড়ে ফুলটুল ফুটিয়ে নিজের স্বাস্থ্য নষ্ট করলে। লাভ কী হলো তাতে? আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, গত এক বছর ঘুমিয়ে নিজের স্বাস্থ্যে কত উন্নতি করলাম? তোমার মতো তো আমি শক্তির অপচয় করে নিজের যোগ্যতা শেষ করছি না। দেখো আমাকে, আমি নিজের ভেতর শক্তি জমিয়ে রাখছি।’
একটু দম নিয়ে শামুক আবার বলল, ‘আচ্ছা, এতদিন এত ফুল ফোটালে, কিন্তু কখনও ভেবেছ, এটা করে কার কী লাভ হচ্ছে? আমার তো মনে হয়, ফুল ফুটলেই কী- না ফুটলেই কী?’
শামুকের এত প্রশ্নের মুখে গোলাপগাছ রীতিমতো থতমত খেয়ে গেল! বলল, `না তো, কখনও তো এ কথা আমি ভেবে দেখিনি? ফুল ফোটাতে ভালো লেগেছে। না ফুল ফুটিয়ে থাকতে পারিনি- তাই ফুটিয়েছি। সূর্য আলো ছড়িয়ে আমার পাতায় পাতায় শক্তি দিয়েছে। দখিনা বাতাস আমার শরীরে ঠান্ডা বুলিয়ে দিয়েছে, ভোরবেলার শিশির আমার মুখ ধুইয়েছে আর বর্ষার স্নিগ্ধ জল ধুইয়েছে আমার গা। আনন্দে আমার পাঁপড়িগুলো কাঁপতে থাকে। আমি কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। নীল আকাশের নিচে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে ফুটে উঠি।'
‘জীবনটা তোমার খুব মজার দেখছি'- শামুক ফোড়ন কেটে বলে!
‘তা অবশ্য মিথ্যে নয়- তবে আপনার জীবনও তো কম সুন্দর নয়! আপনি ভবিষ্যতে পৃথিবীর যত উপকার করবেন, তা কী আর আমি কখনও করতে পারব।’- গোলাপগাছ সবিনয়ে বলে।
শামুক নাক সিঁটকালো, ‘কী সব বলো! আমি পৃথিবীর উপকার করব? বোকার মতো কথা বল- শুনলে হাসি পায়! নিজের উপকার করাই হলো সবচেয়ে বড় কাজ। এই কথাটিই সর্বদা মনে রেখ। তোমার মতো ফুল ফুটিয়ে-ফুটিয়ে শুকনা কাঠি হয়ে মরার কি কোনো দাম আছে?’
এরপর গোলাপগাছের দিকে কটমট করে তাকাতে-তাকাতে শামুক খোলের ভেতর ঢুকে সামনের দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর দিল ঘুম।
গোলাপগাছ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারি না। বাব্বাহ, কী রকম গুটিশুটি মেরে ঢুকে গেল খোলের ভেতর। বাইরে ওর কোনো নাম নিশানাও রইল না। আমি তবে ও রকম করে কিছুতেই নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে পারব না! ফুল ফুটিয়ে গন্ধ বিলিয়ে যাব। তাতে যদি আমি রোগা হয়ে যাই, তাতেও সমস্যা নাই। ছোটোরা যখন খেলতে এসে আনন্দে আমার দিকে তাকিয়ে হাত তালি দেয়, পথিকেরা পথ চলতে চলতে থেমে যায়- অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, তখন আমার কী যে ভালো লাগে! এই ভালো লাগার মানে কি আর শামুক বুঝবে?’
শামুক কিন্তু গোলাপগাছের এসব কথা শুনতে পারল না, কেননা- সে তো নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। এমনি করেই কেটে গেল অনেক বছর। গোলাপগাছ কত ফুল ফোটালো, ছড়ালো মাতাল করা সুগন্ধ, আনন্দ জাগালো সবার মনে। তারপর একদিন মারা গেল।
যতদিন তারা বেঁচেছিল- যখনই দেখা তার হতো শামুকের সঙ্গে, তখনই শামুক- কর্মপদ্ধতি, মহতী কাজ এবং মহত্ত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দিত। শেষে ক্লান্ত হয়ে আবার নিজের খোলের ভেতর ঢুকে যেত।
গোলাপগাছ কখনও বুঝতে পারেনি, কার জীবন সুন্দর, তার না শামুকের?
তুমি বলতে পারো- কার?
.
মূল কাহিনি: দ্য স্নেইল অ্যান্ড দ্য রোজ ট্রি। লেখক: হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন