এক দেশে ছিল এক গরিব মুচি। গরিব হলেও মুচি ছিল ভীষণ কর্মঠ আর সৎ। বেচারা যথেষ্ট খাটাখাটনি করেও কিছুতেই নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারছিল না। দিন দিন সে গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছিল। শেষে অবস্থা এতটা করুণ হলো যে, চামড়া কিনে জুতা বানাবে সেই পয়সাও মুচির কাছে ছিল না। যেটুকু চামড়া তার কাছে ছিল, সেটা দিয়ে বড়জোর একপাটি জুতা বানানো সম্ভব।
কী আর করা! পরদিন সকালে এক পায়ের জুতা তৈরি করার ইচ্ছায় সন্ধ্যার দিকে বসে মুচি চামড়া মাপমতো কাটছাঁট করে রাখল। তারপর শান্ত মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ভোরে মুচি সকালের প্রার্থনা সেরে, জুতা বানানোর কাজে বসতে গিয়ে দেখে তার টেবিলের ওপর নিখুঁতভাবে তৈরি একজোড়া জুতা রাখা আছে। মুচি জুতা জোড়া দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তার মুখে কোনো কথাই ফুটল না। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে সে খুব খুঁটিয়ে দেখল। জুতার সেলাই এত চমৎকার, কোথাও একবিন্দু খুঁত নেই! মুচি এমন অসাধারণভাবে তৈরি জুতা দেখেনি আগে।
কিছু সময়ের মধ্যেই মুচির দোকানে এক ক্রেতা এলেন। জুতা জোড়া তার ভীষণ পছন্দ হলো। বেশ ভালো দামেই ক্রেতাটি জুতা জোড়া কিনে নিয়ে গেলেন।
জুতা বিক্রির টাকায় মুচি আরও দুই জোড়া জুতা বানানোর মতো চামড়া কিনে আনল। সকালে উঠে বানাবে বলে দ্বিগুণ উৎসাহে রাতেই মুচি চামড়া কেটে-ছেঁটে রেখে দিল। চামড়া কেটে রাখার কষ্টটুকু মুচির না করলেও মনে হয় চলত। কারণ পরদিন সকালেও ঘুম ভেঙে সে তার কাজের টেবিলে দুই জোড়া তৈরি জুতা দেখতে পেল।
তৈরি সেই জুতা কেনার জন্য ক্রেতারও যেন তর সইছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ দামে দুই জোড়া জুতাই বিক্রি হয়ে গেল।
এবার মুচি সে টাকায় চার জোড়া জুতার জন্য চামড়া কিনে আনল। পরদিন সকালেও মুচি একই ঘটনা ঘটতে দেখল। চার জোড়া তৈরি জুতা তার টেবিলে বিক্রির জন্য প্রস্তুত।
এই অদ্ভুত ঘটনা দিনের পর দিন চলতে থাকল। প্রতি সন্ধ্যায় মুচি জুতা তৈরির জন্য মাপ মতো চামড়া কেটে-ছেঁটে রেখে দেয়, আর সকালে উঠে টেবিলে তৈরি জুতা পেয়ে যায়। শিগগিরই মুচির গরিবি ঘুচে গিয়ে অবস্থা ফিরতে লাগল। একসময় মুচি বেশ ধনী হয়ে গেল।
এদিকে বড় দিনের আর বেশি দেরি নেই। চারদিকে বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে কেনাকাটা, আনন্দের হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। এ রকম এক সন্ধ্যায় জুতার জন্য চামড়া কাট-ছাঁট সেরে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মুচি তার বউ কে বলল, 'আচ্ছা আজ রাতে আমরা যদি না ঘুমিয়ে দেখার চেষ্টা করি, কারা আমাদের জুতা তৈরিতে সাহায্য করে, কেমন হয়?'
স্বামীর কথা মুচি বউয়ের খুব মনে ধরল। কে তাদের সাহায্য করে সেটা দেখার কৌতূহলে, একখানা মোমবাতি জ্বেলে রেখে, মুচি আর মুচিবউ হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়ের আড়ালে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকল।
সময় পেরিয়ে যখন মধ্যরাত, তখন মুচি আর তার বউ দেখতে পেল, দুজন খুদে আকারের দেবদূত কোত্থেকে বেরিয়ে এসে মুচির জুতা বানানোর টেবিলে বসে কেটে রাখা জুতা সেলাই করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বামন দুজন একদম ন্যাংটো পুঁটে। একটা সুতা পর্যন্ত নেই তাদের শরীরে। তারা তাদের ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জুতা সেলাই, হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকা ইত্যাদি এত দ্রুত করছিল, দেখে মুচির চোখ ছানাবড়া হওয়ার দশা!
চোখের পলক না ফেলে, তাজ্জব হয়ে মুচি আর মুচিবউ লুকিয়ে বামন দুটার কাজ দেখতে লাগল। বমন দুটি এক মনে জুতা সেলাইয়ের কাজ করে টেবিলের ওপর তৈরি জুতাগুলো সাজিয়ে রেখে যেমন ভোজবাজির মতো উপস্থিত হয়েছিল, তেমনি দ্রুত হারিয়ে গেল।
পরদিন সকালে মুচিবউ তার স্বামীকে বলল, 'খুদে বামন দুটির জন্য আমাদের অবস্থা ফিরেছে, আমাদের অবশ্যই এ জন্য তাদের কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। হুটোপুটি করে তারা চলে গেল। খেয়াল করেছ তাদের পরনে কোনো কাপড় নেই। ঠান্ডায় বেচারারা না জানি কত কষ্ট পায়। ওদের জন্য কী করব, সেটা বলছি শোনো। আমি ওদের জন্য ছোট ছোট দুই জোড়া জামা,প্যান্ট, কোট আর দুই জোড়া হাত মোজা, পা মোজা তৈরি করে দেব। আর তুমি দুজনের জন্য দুই জোড়া জুতা তৈরি করে দেবে।'
মুচি খুশি মনে বলল, 'ওদের জন্য কিছু করতে পারলে আমারও খুব আনন্দ হবে।'
সবকিছু তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এক রাতে মুচি আর তার বউ উপহারগুলো টেবিলের ওপর সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল। সেদিন মুচি আর জুতা তৈরির জন্য কোনো চামড়া কেটে রাখল না।
তাদের উপহার পেয়ে বামন দুজন কী করে সেটা দেখার জন্য মুচি আর মুচিবউ আড়ালে লুকিয়ে থাকল।
ঠিক মাঝ রাতের দিকে বামন দুজন উপস্থিত হলো। এসেই তারা জুতা তৈরির জন্য কেটে রাখা চামড়ার খোঁজ করে পেল না। তার বদলে দেখতে পেল টেবিলের ওপর সাজানো রয়েছে চমৎকার ছোট ছোট জামা, প্যান্ট, জুতা এসব। জিনিসগুলো দেখে প্রথমে বামন দুজন অবাক হলো। তারপর যখন বুঝল উপহারগুলো তাদের জন্যই রাখা হয়েছে, তখন আনন্দে হাত-পা ছুড়ে নেচে নিলো একপাক।
উপহারগুলো তাদের এতই পছন্দ হয়েছে যে চোখের পলকে তারা সেগুলো পরা শুরু করল। পরতে পরতে মনের আনন্দে বামন দুজন গান জুড়ল-
কাপড় জামায় লাগছে মোদের লক্ষীমন্ত ছেলে
মুচির কাজ করব না আর এসব কিছু ফেলে!
চেয়ার টপকে, বেঞ্চ ডিঙ্গিয়ে তারা গাইতে গাইতে আর নাচতে নাচতে দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। এরপর বামন দুজনকে মুচি তার বউ, আর কখনও দেখতে পেল না।
জুতা তৈরির জন্য বামন দুজন আর না এলেও মুচি কিন্তু নিজের কাজে এক বিন্দু ফাঁকি দিল না। সে তার কাজ মন দিয়ে করে যেতে লাগল। যে কারণে তার অবস্থার আরো উন্নতি হলো। বাকি জীবনটা মুচি আর মুচিবউ খুব সুখে-শান্তিতে কাটাল।
মূল গল্প: দি এলভস অ্যান্ড দ্য শুমেকার