বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টুনটুনি আর টুনটুনা

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:৩৯

এক আনার পয়সাটা বাসার মাঝখানে রাখিয়া টুনটুনি আর টুনটুনা তার চারদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচে আর গান করে— “রাজার আছে যত টাকা, মোদের আছে তত টাকা।”

টুনটুনি আর টুনটুনা, টুনটুনা আর টুনটুনি। এ ডাল হইতে ও ডালে যায়। ও ডাল হইতে সে ডালে যায়। সে ডাল হইতে আগডালে যায়। আগডাল হইতে লাগডালে যায়। বেগুনগাছে যায়, লঙ্কাগাছে যায়, আমগাছে যায়, জামগাছে যায়। সারা দিন কেবল ফুড়ুত ফুড়ুত। এ গাছ ও গাছ করিয়া টুনটুনিদের জীবন কাটে।

একদিন টুনটুনা টুনটুন করিয়া টুনটুনিকে বলে, “দেখ টুনটুনি! আমাদের যদি টাকা-পয়সা থাকিত তবে কি মজাই না হইত। তোকে ভালোমতো একখানা শাড়ি কিনিয়া দিতে পারি না। আমি একখানা ভালো জামা-কাপড়ও পরিতে পারি না। দেশের বড় লোকেরা কত রং-বেরঙের জামা-কাপড় পরে। কেমন বুক ফুলাইয়া চলে।”

টুনটুনি বেশ গুমর করিয়া বলে, “দেখ টুনটুনা! শুনিয়াছি বনের মধ্যে নাকি সোনার মোহরভরা কলস থাকে। আমি যদি তার একটা কুড়াইয়া পাই, তবে বেশ মজা হয়।"

টুনটুনা বলে, “সত্য কথাই বলিয়াছিস। দেখ টুনটুনি! বনের মধ্যে খুঁজিয়া খুঁজিয়া যেমন করিয়া হোক, একটা মোহরভরা কলস আমি বাহির করিবই।”

টুনটুনি বলে, “তা তুমি বনের মধ্যে খুঁজিয়া খুঁজিয়া দেখ, কোথায় মোহরভরা কলস আছে; আমি এদিকে বাসা সামলাই।”

টুনটুনা এ বনে খোঁজে, সে বনে খোঁজে। বেতের ঝোপের আড়াল দিয়া, শিমুল গাছের গোড়া দিয়া, হিজলগাছের তলা দিয়া। কোথাও মোহরভরা কলস পায় না।

খুঁজিতে খুঁজিতে খুঁজিতে গহিন বনের ভিতর টুনটুনা এক আনার একটা পয়সা পাইল। তাই ঠোঁটে করিয়া টুনটুনা ঘরে ফিরিয়া আসিল।

‘টুনটুনি শিগগির আয়, শিগগির আয়! দেখিয়া যা কী আনিয়াছি।'

টুনটুনি বলিল, ‘কী আনিয়াছ?’

টুনটুনা আরও খানিক দম লইয়া বলে, ‘আমরা বড়লোক হইয়া গিয়াছি।'

‘বড়লোক কেমন রে টুনটুনা? বড়লোক হইলে কী হয়?' টুনটুনি ঠোঁট উঁচাইয়া টুনটুনাকে জিজ্ঞাসা করে।

টুনটুনা এক আনার পয়সাটা দেখাইয়া বলিল, ‘এটা অনেক মূল্যবান জিনিস। এইটি দিয়া যা যা দরকার হয়, সব কিনিব।'

টুনটুনি বলে, ‘সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতোয়া, মিহিদানা সব কিনিতে পারিব? যা ইচ্ছা কিনিতে পারিব? চকলেট, লজেন্স, বিস্কুট?' টুনটুনি লেজ নাচাইয়া জিজ্ঞাসা করে।

টুনটুনা উত্তর করে, ‘হা-হা সবকিছু।'

এক আনার পয়সাটা বাসার মাঝখানে রাখিয়া টুনটুনি আর টুনটুনা তার চারদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচে আর গান করে—

‘রাজার আছে যত টাকা,

মোদের আছে তত টাকা।'

তারা নায় না, খায় না, বেড়ায় না, শোয় না। মনের আনন্দে সেই এক আনার পয়সার চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচে আর সেই গান গায়—

‘রাজার আছে যত টাকা,

মোদের আছে তত টাকা।'

একদিন হইয়াছে কি? সেই দেশের রাজা শিকারে চলিয়াছেন। আগে-পিছে মন্ত্রী-কোতোয়াল, লোক-লশকর, পেয়াদা-পাইক কেবল গমগম করিতেছে। যাইতে যাইতে যাইতে তাহারা সেই টুনটুনি আর টুনটুনার বাসার কাছে আসিয়া উপস্থিত। তখন রাজা শুনিতে পাইলেন, টুনটুনি আর টুনটুনা গান গাহিতেছে—

‘রাজার আছে যত টাকা,

মোদের আছে তত টাকা।'

রাজা রাগিয়া বলিলেন, ‘কী, এত বড় বুকের পাটা! ছোট্ট এতটুকুন টুনটুনি, এক রত্তি টুনটুনা গান গায়—

রাজার আছে যত টাকা, মোদের আছে তত টাকা।

এতবড় রাজদ্রোহীদের সাজা হওয়া উচিত। কোন দিন তারা রাজ্য আক্রমণ করিয়া বসে তার ঠিক কী!'

তখন রাজা সেপাইকে হুকুম করিলেন, ‘দেখ তো কী আছে উহাদের বাসার মধ্যে।'

রাজার হুকুম পাইতে না পাইতেই সেপাই টুনটুনির বাসায় যাইয়া দেখিয়া রাজার কাছে আসিয়া নিবেদন করিল, ‘মহারাজ! টুনটুনি পাখির বাসায় এক আনার একটা পয়সা আছে।'

‘কী, এক আনার একটা পয়সার জন্য টুনটুনির এত আস্পর্ধা! ওর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত কর। ঘরদোর যা কিছু আছে ভাঙিয়া ফেল।' গোস্বায় রাজা কলাপাতার মতন কাঁপিতে লাগিলেন।

রাজার মুখ হইতে কথা বাহির হইতে না হইতে কোতোয়াল সৈন্যসামন্ত, দারোগা-পুলিশ লইয়া টুনটুনির বাসা ঘিরিয়া ফেলিল। তারপর এক আনার পয়সা আনিয়া রাজকোষে জমা দিল। রাজার হাতি গিয়া টুনটুনি পাখির বাসা ভাঙিয়া পায়ের তলে পিষিয়া ফেলিল।

টুনটুনি পাখির গান তবু থামে না। তারা এ ডাল হইতে ও ডালে, ও ডাল হইতে এ ডালে আসে, রাজার মাথার উপর দিয়া ফুড়ুত ফুড়ুত করিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়—

‘রাজার আছে যত টাকা,

মোদের আছে তত টাকা।'

কী, এত বড় রাজদ্রোহী এই টুনটুনি পাখি! স্পর্ধা ত কম না! রাজাকে অপমান! রাজা এবার রাগে জ্বলিয়া উঠিলেন।

‘কে আছ, এখনই এই টুনটুনি পাখিকে বন্দি কর।'

রাজার হুকুম পাইয়া কোতোয়াল হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন – সোয়া লক্ষ দারোগা, জমাদার, সিপাই, মার মার করিয়া উঠিলেন। সোয়া লক্ষ সিপাই সোয়া লক্ষ বন্দুক গুড়ুম করিয়া আওয়াজ করিলেন। সোয়া লক্ষ কামান কাঁধে করিয়া সোয়া লক্ষ গদাইলশকর হনহন করিয়া ছুটিল।

কিন্তু কামানের গুড়ুম আর টুনটুনি পাখির ফুড়ুত ফুড়িত বন্দুকের ফুটুৎ ফুটুৎ আর টুনটুনি পাখির সুরুৎ সুরুৎ কিছুতেই থামে না। এদিক হইতে যদি কামান গর্জায়, টুনটুনি পাখি ওদিকে চলিয়া যায়। ওদিক হইতে যদি বন্দুক ফটকায় টুনটুনি পাখি এদিকে চলিয়া আসে।

এতটুকুন দুটি পাখি! গায়ে বন্দুকের গুলিও লাগে না, কামানের গোলা বারুদও আঘাত করে না | সোয়া লক্ষ দারোগা, জমিদার রোদে ঘামিয়া উঠিলেন।

সোয়া লক্ষ গদাইলশকর দৌড়াইতে দৌড়াইতে হাপুসহুপুস হইয়া গেলেন; কিন্তু টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিলেন না।

রাজা তখন রাগিয়া অস্থির। প্রধান সেনাপতিকে ডাকিয়া কহিলেন, ‘যদি টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিয়া আনিতে না পার, তবে তোমার গর্দান কাটিয়া ফেলিব!'

গর্দান কাটার ভয়ে প্রধান সেনাপতি বনের মধ্যে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন!

বনের মধ্যে ছিল এক কাঠুরিয়া। সে-ই প্রধান সেনাপতিকে পরামর্শ দিল, ‘বলি, সেনাপতি মহাশয়, কামান বন্দুক দিয়া টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিবেন না। জেলেকে ডাকিয়া বনের মধ্যে জাল ফেলিতে বলুন। সেই জালে টুনটুনি পাখি ধরা পড়িবে।'

কাঠুরিয়ার কথা শুনিয়া প্রধান সেনাপতি জেলেকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সোয়া লক্ষ নাতিপুতি লইয়া জেলে আসিয়া সমস্ত বন জুড়িয়া জাল পাতিল। সেই জালে টুনটুনি আর টুনটুনা ধরা পড়িল। টুনটুনি আর টুনটুনাকে হাতে পাইয়া রাজা ঘরে চলিলেন।

রাজার একশ এক রানী। পিলে রানী, জুরো রানী, কেশো রানী, বেতো রানী, মোটা রানী, পাতলা রানী, খোঁড়া রানী, তোতলা রানী, কানা রানী, বোবা রানী, আলসে রানী, চটপটে রানী, দুষ্টু রানী, মিষ্টি রানী, কত রানীর নাম আর করিব। সব রানী আসিয়া রাজাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। কেহ খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আসিল, কেহ জ্বরে কাঁপিতে কাঁপিতে আসিল, কেহ আলসি ভাঙিতে ভাঙিতে ভাসিল, কেহ চটপট করিয়া আসিল, কেহ ঘুমে ঢুলিতে ঢুলিতে আসিল।

সবাই আসিয়া রাজাকে ধরিল, ‘মহারাজ, আজ শিকারে যাইয়া কী আনিলেন?'

রাজা বলিলেন, ‘আজ শিকারে যাইয়া টুনটুনি আর টুনটুনা পাখি ধরিয়া আনিয়াছি।'

তখন পিলে রানী পিলের ভরে কোঁকাইতে কোঁকাইতে বলিলেন, ‘দেখি তো কেমন টুনটুনি পাখি?'

রাজা পিলে রানীর হাতে পাখি দুটি দিয়া রাজসভায় যাইয়া এই রাজদ্রোহী পাখি দুটির বিচারের বন্দোবস্ত করিতে মনোযোগ দিলেন।

এদিকে পিলে রানীর হাত হইতে টুনটুনি পাখি গেল জুরো রানীর হাতে। তার হাত হইতে গেল কেশো রানীর হাতে। তারপর এর হাতে ওর হাতে নানা হাতে ঘুরিতে ঘুরিতে টুনটুনি পাখি যখন আলসে রানীর হাতে আসিল, অমনি টুনটুনি করিল ফুড়ুত ফুড়ুত, টুনটুনা করিল সুরুৎ সুরুৎ! দুইজন দুই দিকে পালাইল। রাজার একশ এক রানী ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।

পরদিন রাজা রাজসভায় বসিয়া আছেন। কাশী, কাঞ্চি, কনোজ নানান দেশ হইতে পণ্ডিতেরা আসিয়াছেন রাজদ্রোহী টুনটুনি আর টুনটুনা পাখির বিচার করিতে।

রাজসভায় পাখিদের কেতাব উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পণ্ডিতেরা রাজদ্রোহী পাখির কী শাস্তি হইতে পারে তাই বাহির করিতে ব্যস্ত। ওদিকে টুনটুনা আর টুনটুনি পাখি আসে না।

রাজা রাগিয়া মাগিয়া রাজসভা ছাড়িয়া রানীদের মধ্যে যাইয়া উপস্থিত, ‘কোথায় সেই রাজদ্রোহী পাখি দুটি?‘

তখন এ রানী চায় ও রানীর মুখের দিকে, ও রানী চায় সে রানীর মুখের দিকে। রাজার মাথার উপর তখন টুনটুনি পাখি উড়িয়া চলিয়াছে ফুড়ুত ফুড়ুত। রাজা সবই বুঝিতে পারিলেন। রাগিয়ামাগিয়া রাজা তখন একশ এক রানীর নাক কাটিয়া ফেলিলেন।

টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রজার মাথার ওপর দিয়া ফুড়ুত ফুড়ুত ওড়ে, আর গান গায়—

‘টুনাটুন-টুনাইলাম,

একশ রানীর নাক কাটাইলাম।‘

কী, এত বড় বুকের পাটা! টুনটুনি পাখির রাজার কুলের কথা লইয়া ছড়া কাটে! ধর টুনটুনি পাখিকে।

জেলে আবার তার সোয়া লক্ষ নাতিপুতি লইয়া রাজবাড়িতে হাজির। পাখি দুটি জালে ধরা পড়িল। রাজা তাহাদের হাতে পাইয়া কলাপাতার মতো কাঁপিতে লাগিলেন। এবার আর বিচার-আচারের প্রয়োজন নাই। এক গ্লাস পানি লইয়া রাজা পাখি দুটিকে গিলিয়া খাইয়া ফেলিলেন।

তখন রাজসভায় বড় বড় পণ্ডিত বড় বড় কেতাব দেখিয়া মাথা নাড়িলেন। তাহাদের মাথানাড়া দেখিয়া মন্ত্রী মহাশয় ভাবিত হইলেন। পণ্ডিতেরা মন্ত্রী মহাশয়কে সাবধান করিয়া দিলেন, “মহারাজ যদি কোন মুহুর্তে হাসিয়া উঠেন, তবে পাখি দু’টি রাজার হাসিমুখের ফাঁক দিয়া বাহির হইয়া আসিবে।”

মন্ত্রী মহাশয় সেয়ান লোক। তিনি খাড়া তলোয়ার হাতে দুই সেপাইকে রাজার দুই পাশে দাড় করাইয়া দিলেন। যদিবা রাজা মহাশয় হাসিয়া ফেলেন, আর সেই ফাঁকে টুনটুনি পাখিরা বাহির হইয়া আসিতে চায়; তখনি তারা তলোয়ার দিয়া মারিবে কোপ।

খোকাখুকুরা, তোমরা কেহ হাসিও না যেন! কেউ হাসিও না। একি হাসিয়া দিলে যে? তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রাজা মহাশয়ও যে হাসিয়া উঠিলেন। সেই হাসির ফাঁকে টুনটুনি আর টুনটুনা ফুরুৎ করিয়া উড়িয়া পালাইল।

রাজার দুইধার হইতে দুই সেপাই তলোয়ার উঠাইয়া মারিল কোপ। টুনটুনির গায় ত লাগিল না, লাগিল রাজা মহাশয়ের নাকে। নাক কাটিয়া দুইখান।

টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রাজা মহাশয়ের মাথার উপর দিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়--

‘টুনটুনা টুন-টুনটুনাইলাম

রাজা মশাইর না কাটাইলাম, নাক কাটাইলাম।'

এ বিভাগের আরো খবর