সে বহুকাল আগের কথা। বহুদূরে ছিল একটা দেশ। যেখানে পরিরা এসে মানুষের সঙ্গে গল্প করত।
পাখিরা, মাছেরা সব কথা বলত। যেখানে ছিল বৃষ্টিগাছ। যে গাছের নিচে দাঁড়ালেই বৃষ্টি ঝরত। সঙ্গে মিষ্টি সুবাস।
সেখানে ছিল একটি সুখ নদী। যে নদীর পাশে বসে কেউ দুঃখের কথা কইলে, নদী তার দুঃখ দূর করে দিত।
সেই নদীর পাশেই ছিল একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামেই থাকত লক্ষ্মী এক মেয়ে। সবাই তাকে রিমঝিম বলে ডাকত।
সবাই নিজের ঘরে ডেকে খাওয়াতো রিমঝিমকে। সে যে ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।
বয়স আর কত হবে। এই ১৭-১৮।
রিমঝিম সারাদিন ঘুরত, প্রজাপতিদের সঙ্গে নাচত, বনের পাখির সঙ্গে গাইত। কি মধুর তার কণ্ঠ। তার গান শুনে, বনের সব গাছের পাতা নাচত, জলের মাছ ডাঙায় উঠে সে গান শুনত।
সন্ধ্যাবেলায় পরিরা এসে গল্প করত তার সঙ্গে। উপহার হিসেবে নিয়ে আসত কত্ত আজব আজব জিনিস। সেসব পেয়ে খিলখিলিয়ে হাসত রিমঝিম।
একদিন সুখ নদীর পাশে বসে একমনে কাঁদতে লাগল রিমঝিম। গাল বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল সুখ নদীতে।
সুখ নদী বলে উঠল, ‘ওমা এ কি গো রিমঝিম, তোমার চোখে জল! কি দুঃখ তোমার, বলো আমায়। সব দূর করে দিব আমি।’
‘আমার মা যে বড্ড অসুস্থ গো সুখ নদী। কেউ কইতে পারে না কী হয়েছে তার। ও পাড়ার দিদিমা বলেছে, মা নাকি বেশিদিন আর বাঁচবে না। মা না থাকলে আমার কি কোনো সুখ থাকবে বলো?’- কাঁদতে কাঁদতে বলল রিমঝিম।
রিমঝিমের কান্না দেখে পুরো নদীর জল কেঁপে উঠল। নদীর মাছেরা সুখ নদীকে মিনতি করে বলল, ‘ও গো সুখ নদী, তুমি তো সবাইকে সুখী করো। রিমঝিমের মাকে তুমি ভালো করে দাও। নইলে আমরা আর কোনে মানুষের জালে ধরা দেব না।’
বনের গাছেরা মাটিকে বলল, ‘মাটি, তুমি আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছ। রিমঝিমের মাকে তুমি বাঁচিয়ে দাও। নইলে আমরা আর কোনো ফুল, ফল দিব না।’
রাতে আলোচনা সভায় বসল সুখ নদী, বনের মাটি, বাতাস আর পরিরা। সবাই অনেক ভেবে খুঁজে পেল রিমঝিমের মাকে বাঁচানোর উপায়।
রিমঝিমকে ডেকে বলল, ‘তোমার মাকে বাঁচানোর একটা উপায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু সে যে বড় কঠিন উপায়।’
রিমঝিম কেঁদে কেঁদে বলল, ‘বলো তোমরা আমায়, কী সে উপায়। মাকে বাঁচাতে আমি সব করতে পারব।’
‘বেশ, কাল ভোরে যখন সূর্য মামা পুব আকাশে উঁকি দিবে, তখন একটা ফানুস করে আমরা সবাই তোমায় উড়িয়ে দিব। সে ফানুস গিয়ে যেখানে পড়বে, সেখানেই মিলবে তোমার মাকে বাঁচানোর উপায়’- বলল সুখ নদী।
ভোর বেলায় একটি বড় ফানুসে বসিয়ে রিমঝিমকে আকাশে উড়িয়ে দিল সবাই। কাঁদল রিমঝিম, গ্রামের মানুষ, নদী, গাছ, মাছসহ সবাই।
উড়তে উড়তে বহুদূর চলে গেল ফানুস। গিয়ে পড়ল অচেনা এক রাজ্যে।
সেখানে ঘাসগুলো সব ফ্যাকাসে, গাছে নেই কোনো পাতা, নদীতে নেই কোনো জল।
হাটতে হাটতে এক বিরাট রাজপ্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়াল রিমঝিম। অন্দর মহলে ঢুকে দেখল রাজা বসে কাঁদছে।
তার কাছে গিয়ে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
রাজা মাথা তুলে দেখল লাল পেড়ে ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। বলল, ‘কে তুমি মা? কোথায় থেকে এসেছ?’
‘আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। কী হয়েছে আপনাদের রাজ্যে?’
আমার এই রাজ্যে অভিশাপ পড়েছে। তাই কোনো গাছে ফল নেই, নদীতে জল নেই। না খেতে পেরে আমার সব প্রজারা মরে যাচ্ছে। আমার একমাত্র নয়নের মনি রাজপুত্রও পানির অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।’
‘আমি পারব আপনার রাজ্যকে বাঁচাতে’– বলল রিমঝিম।
‘কী বললে মা তুমি! তুমি পারবে? কী করে! কথা দিচ্ছি, যদি তুমি সত্যি আমার রাজ্য, আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারো, তাহলে যা চাও তা-ই পাবে’- বলল রাজা।
রিমঝিম বাইরে বেরিয়ে এসে গান গাইতে শুরু করল। তার সে গান শুনে ঘাসগুলো সব সতেজ হয়ে গেল। গাছগুলো সব পাতায় পাতায় ভরে উঠল। নদী জলে ভরে গেল। সঙ্গে কত মাছ।
জল খেয়ে বাঁচল রাজপুত্রের প্রাণ। তার সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে নিজের দুঃখের কথা বলল রিমঝিম।
রাজপুত্র বলল, ‘আমি জানি, কী করে তোমার মা কে বাঁচাবে।’
রিমঝিম বলল, ‘কী করে! বলো আমায় সে উপায়?’
রাজপুত্র বলল, ‘এ রাজ্যের পূর্ব কোণে আছে এক বৃষ্টিগাছ। সে গাছের নিচে দাঁড়ালেই বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির জল যদি খাওয়াতে পারো তোমার মাকে, বাঁচবে তিনি।’
দুজন মিলে চলে গেল সে বৃষ্টিগাছের কাছে। ভিজল আর শিশি ভরে নিল সেই বৃষ্টির জল।
তারপর রাজকুমার তার ঘোড়ায় চাপিয়ে রিমঝিমকে নিয়ে গেল তার মায়ের কাছে। বৃষ্টির জল খেয়ে সুস্থ হয়ে গেল রিমঝিমের মা। কয়েক বছর পর খবর পাঠিয়ে রিমঝিমকে পুত্রবধূ করে নিয়ে গেল রাজা।