এক গ্রামে ছিল তিন বোকা। তারা যেমন-তেমন বোকা নয়, একেবারে বোকার হদ্দ। বাড়ির লোকজন একদিন তিনজনকে একসঙ্গে গ্রাম থেকে বের করে দিল।
বেচারা বোকা তিনজন গ্রামের বাইরে এসে একটি বড় ছাতিম গাছের ছায়ায় এসে বসল। তারপর তিনজন মিলে ঠিক করল তারা দূর দেশে চলে যাবে।
সেই মতো তিন বোকা নদী-নালা-মাঠ পেরিয়ে নতুন এক গ্রামে গিয়ে হাজির হলো। নতুন গ্রামে এসে তারা একটি বেশ বড়সড় বাড়ি দেখতে পেল। তিন বোকা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সেটা এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি।
মাস্টারমশাই ঠিক, তখনই স্কুলে যাবার জন্য বেরোতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিন বোকা তাঁর পায়ে পড়ে পা চেপে ধরল। মাস্টারমশাই বললেন, ‘ওরে ছাড় ছাড়, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
বোকা তিনজন তবু পা ছাড়ে না। বলল, ‘মাস্টারমশাই আমরা ভিন-গাঁ থেকে এসেছি। আমাদের আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন।’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা। সব ব্যবস্থা ফিরে এসে হবে। বাড়িতে মা রয়েছে। তোরা তার কাছ থেকে খাবার চেয়ে খেয়ে নিবি। তারপর বাড়িতে কিছু কাজকর্ম সেরে রাখবি। আমি ফিরে এসে তোদের ব্যবস্থা করব।’
এই বলে তিনি স্কুলের পথে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।
বোকা তিনজন বুড়িমায়ের কাছে পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচ ভরে খেয়ে নিল। তারপর বলল, ‘বলুন বুড়িমা কী কাজ করতে হবে?’
বুড়িমা বলল, ‘যা তোরা নদীতে স্নান সেরে ঘানি থেকে তিন হাঁড়ি সরষের তেল নিয়ে আয়।’
বোকারা সেই মতো নদীতে স্নান সেরে তেল আনতে চলল। মাটির ছোট ছোট হাঁড়িতে তেল নিয়ে তারা বাড়ি ফিরছে, এমন সময় পথে দেখল একটা প্রকাণ্ড বটগাছ। সেই গাছের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিতে তারা তেলের হাঁড়িগুলো মাটিতে রাখল।
জিরিয়ে টিরিয়ে যেই হাঁড়িগুলোর দিকে তাকিয়েছে, অমনি দেখে তিনটি হাঁড়িতেই চোর ঢুকে বসে আছে। আসলে হাঁড়ির তেলে নিজেদের ছায়া দেখে ভেবেছিল ওগুলো চোর।
অগত্যা নিজেদের ছায়াগুলোকে চোর ভেবে তারা দুমদাম করে লাঠি দিয়ে পেটাতে লাগল। লাঠির ঘায়ে মাটির হাঁড়ি তো ভাঙলই সঙ্গে সঙ্গে তেলও গড়িয়ে পড়ল। অবশেষে তিন বোকা খালি হাতে বাড়ি ফিরে এলো।
মাস্টারমশাই সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে ফিরে সব কথা শুনে বলল, ‘কাল তোরা তিনজন বনে গিয়ে তিন বোঝা শুকনা কাঠ নিয়ে আসবি, এটা পারবি তো?’
বোকারা অনেকখানি ঘাড় কাত করে বলল, ‘পারব'। পরদিন মাস্টারমশাই স্কুলে চলে গেলে বোকা তিনজনও বনের পথ ধরল। তিনজন তিনটি বড়সড় কাঠের বোঝা মাথায় চাপিয়ে বুড়িমার কাছে ফিরে এলো। বুড়িমা তখন খোলা পাতে মুড়ি ভাজছিল। গরমে তার মেজাজ ছিল সপ্তমে। আর ঠিক তখনই বোকা তিনজন চিৎকার জুড়ে দিল, ‘কাঠ এনেছি, রাখব কোথায়?’
তিন বোকা একই কথা বলায় বুড়িমা রেগে-মেগে বললেন, ‘কাঠ রাখার জায়গা পাচ্ছিস না? আমার মাথায় রাখ।’
এই কথা শেষ হতেই বোকা তিনজন তিন বোঝা কাঠ বুড়িমার মাথায় ফেলে দিল। তাতেই বুড়ি মারা গেল।
মাস্টারমশাই ঘরে ফিরে দেখল অনর্থ হয়ে গেছে। কেন যে তিনি বোকাদের আশ্রয় দিলেন? তারপর কান্নাকাটি থামিয়ে বোকাদের নির্দেশ দিলেন, ‘যা তোরা মাকে নিয়ে গিয়ে নদীতে সৎকার করে ফেল। এতে যদি তোদের কিছুটা পাপ কমে।’
বোকারা তখন একটা তালপাতার চাটাইয়ের মধ্যে বুড়িমার দেহটা গুটিয়ে নদীতে নিয়ে চলল। যেতে যেতে কোন সময় বুড়ির দেহটা চাটাই থেকে বাইরে পড়ে গেছে তারা খেয়ালই করেনি।
নদীতে পৌঁছে দেখল বুড়িমা নেই। কোথায় গেল? বোকা তিনজন তখন ভাবল, বুড়িমা নিশ্চয়ই জ্যান্ত হয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ছে। তাই তারা বুড়িকে ধরে নিয়ে আসতে আবার গ্রামের পথে পা বাড়াল।
যেতে যেতে তারা অন্য একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছল। সেই গ্রামে এক বুড়ি ঝাড়ু দিয়ে উঠোন পরিষ্কার করছিল। বোকা তিনজন তাকে দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে এলো। তারপর জোর করে ধরে নদীর কাছে নিয়ে সৎকার করে দিল।
সন্ধ্যায় বোকারা মাস্টারমশাইয়ের কাছে এসে বলল, ‘আজ আমাদের খুব পরিশ্রম গেছে। বুড়িমা তালপাতার চাটাই থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আমরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে সৎকার করে দিয়েছি।’
মাস্টারমশাই বোকাদের কথা শুনে তো একেবারে হাঁ হয়ে গেলেন। অনেক হয়েছে। এরা শুধু বোকা নয়, একেবারে বোকার হদ্দ। এদের কিছুইতেই ঘরে রাখা যাবে না। রাখলেই পদে পদে বিপদ। এই ভেবে তিনি তাদের তাড়িয়ে দিলেন।
তিন বোকা আবার ভিন-গাঁয়ের পথে হাঁটতে লাগল।