ইনুইট কথাটির অর্থ অনেক লোক। আটলান্টিক মহাসাগরের তীর ঘেঁষে এই গ্রামটিতে কিন্তু অল্প কয়েকজন লোকেরই বাস ছিল।
এদেরই একজন ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, একটি ভাঙা ঘরে তার বাস। তিনি এত দুর্বল ছিলেন যে নিজের খাবারের জন্য একটি মাছ বা কিছু শিকার করে আনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে সে গ্রামের নিয়ম ছিল যে কেউ যদি ভালো শিকার পায়, তবে সে সেটা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে। তাই বুড়ির রোজই কিছু না কিছু খাবার জুটে যেত।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে বুড়ি দেখলেন, সামনের বিস্তৃত বরফের প্রান্তরে একটি ছোট্ট ভালুকছানা খেলা করছে।
বুড়ি একটু অবাক হলেন একলা বাচ্চাটাকে দেখে। কারণ এত ছোট বাচ্চা তো মা ছাড়া থাকে না।
তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন যদি মা-ভালুকটাকে দেখতে পাওয়া যায়। তারপর বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় এই বাচ্চাটার মা-টা কারোর হাতে মারা গেছে।
মাথা নেড়ে আক্ষেপ করে বললেন, ‘ইস্, এত ছোট বাচ্চার মাকে কেউ মারে? শরীরে একটু দয়া-মায়া নেই গো ‘
বাচ্চাটার তখন খিদে পেয়েছিল আর তাই সে নানা রকম শব্দ করছিল। বুড়ি এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলেন। কিন্তু তারও তো ঘরে খুব একটা খাবার নেই।
খুঁজে দেখলেন, আগের দিন একটু দুধ আর এক টুকরো সীলের চর্বি দিয়েছিল কেউ। তার খানিকটা বাকি রয়ে গেছে। সেটাই এনে ভালুকছানাটার মুখের সামনে ধরলেন। যত্ন করে ধীরে ধীরে সবটাই খাইয়ে দিলেন তাকে।
বুড়ি ভালুকছানাটার নাম রেখেছেন কুনিকজুয়াক। এই নামে সে আজকাল বেশ সাড়া দেয়।
সে এখন একটু বড় হয়েছে, শিকার করতে শিখেছে, সমুদ্র থেকে সীল, স্যামন মাছ- এগুলো শিকার করতে পারে। যা-ই পায়, সবই এনে দেয় বুড়ির কাছে। তাই আজকাল বুড়ির খাওয়ার কষ্ট ঘুচেছে। শুধু তা-ই নয়, প্রথা অনুযায়ী বৃদ্ধাও আজকাল উদ্বৃত্ত খাবারের ভাগ অন্য গ্রামবাসীর কাছে পাঠাতে পারেন। এ জন্য তাকে বেশ গর্বিত লাগে।
কুনিকজুয়াককে গ্রামের শিশুরা খুব ভালোবাসে। শিকারের সময় বাদে সে ওদের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। আনন্দে সে যখন বরফের ওপর ডিগবাজি খায়, তখন মনে হয় যেন ঠিক একটা সাদা বরফের বল গড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আনন্দ বেশি দিন থাকে না। কুনিকজুয়াক যে এত ভালো শিকার করতে পারে, সেই ব্যাপারটা গ্রামের অনেকের কাছেই ভালো লাগছিল না। ঈর্ষায় জর্জর হয়ে তারা কুনিকজুয়াককে মেরে ফেলবার জন্য ফন্দি আঁটল।
এই খবরটা আবার গ্রামের ছোটরা আড়াল থেকে শুনে ফেলল। তারা তো ভালুকছানাটাকে খুব ভালোবাসে, তাই ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে সাংঘাতিক খবরটা বুড়িকে জানিয়ে দিল, ‘ঠাম্মি, ঠাম্মি, তুমি কুনিকজুয়াককে বাঁচাও। দাদারা ওকে মেরে ফেলার মতলব করছে।’
বুড়ি তো কেঁদে আকুল। এত হিংসা মানুষের মনে! একটা ছোট ভালুকছানাকেও তারা রেহাই দেবে না!
বৃদ্ধা প্রথমে পাড়ার মানুষজনের কাছে মিনতি করলেন, তার আদরের ছানাটার প্রাণ ভিক্ষা দেয়ার জন্য। তাতে যখন কিছুই হলো না, তখন দৌড়ে ঘরে এসে কুনিকজুয়াককে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘বাছা তুই এখনই এখান থেকে পালা। নইলে তোকে ওরা মেরে ফেলবে যে।’
বুড়ির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। ছোট ছানাটাকে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু বুড়ি বিপদের কথা ভুললেন না। ভালুকছানাটাকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিয়ে বুড়ি বললেন, ‘আর কখনও এখানে ফিরে আসিস না সোনা।’
এই কথা বলতে তার গলা ভেঙে গেল; তিনি আবার কাঁদতে লাগলেন। তার চোখের সামনে কুনিকজুয়াক দৌড়াতে দৌড়াতে বরফের প্রান্তরে মিলিয়ে গেল। তার জন্য গ্রামের ছোট্ট বন্ধুরাও কেঁদে আকুল হলো।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে, ভালুকছানার আর কোনো খোঁজ নেই। বুড়ির অবস্থা আবার আগের মতো হয়েছে। খাবার জোগাড় নেই, কেউ দেখেও না। মনের কষ্টে আর খিদের কষ্টে একদিন বুড়ি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ছানাটার খোঁজে। কে জানে সে এখন কত বড় হয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বরফের প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধা কুনিকজুয়াকের নাম ধরে বারবার ডাকতে লাগলেন। হঠাৎ দেখে দূর থেকে একটা বিশাল সাদা ভালুক দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। ঘন লোমে ঢাকা মোটাসোটা বিশালাকৃতি ধবধবে সাদা একটা ভালুক বুড়ির পায়ের সামনে এসে ঝুপ করে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল।
এটিই সেই কুনিকজুয়াক; তবে সে এখন আর ছোট্টটি নেই। পূর্ণবয়স্ক এক সাদা মেরু ভল্লুক, ইচ্ছামতেআ ঘুরে বেড়ায়, কারো পরোয়া করে না।
তবে সে যে বুড়িকে ভোলেনি, তার প্রমাণ তো সে দেখিয়েই দিল। বুড়িও তাকে অনেক কেঁদে গায়ে বারবার হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন। তারপর তাকে নিজের অবস্থার কথা বলে তার কাছে খাবার চাইল। কুনিকজুয়াক কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে অনেক স্যামন মাছ এনে দিল। বুড়ি তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। বাদবাকি সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
সেই থেকে বুড়ি যত দিন বেঁচে ছিলেন, এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। বুড়ি মাঝে মাঝে তার আদরের ছানার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন আর খাবার-দাবার নিয়ে ফিরে আসতেন।
শেষ পর্যন্ত বুড়ি যখন আর পারেন না, তখন কুনিকজুয়াক তাকে রাতের অন্ধকারে খাবার দিয়ে যেত।
লোকে জানত ভালুকটা কে, কিন্তু এত বড় ভালুকের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে উঠবে না বলে ভয়ে চুপ করে যেত। তবে বুড়ি মারা যাবার পর কেউ আর তাকে সে গ্রামে দেখেনি।