বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আলুথালু

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ৯ জুলাই, ২০২১ ১১:১৮

অনেক রাত পর্যন্ত হেঁটে চলল জমিদারকন্যা যেদিকে দুচোখ যায়। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন ভারি ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তখন প্রকাণ্ড একটা গাছের গুঁড়ির খোড়লের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

এক ছিলেন ধনী জমিদার। তার টাকা-পয়সা ধনদৌলতের অন্ত ছিল না!

জমিদারের স্ত্রী বেঁচে নেই। তার তিন মেয়ে। মেয়েদের তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন।

জিজ্ঞেস করে দেখা যাক।

রাতের খাবারের পর বড় মেয়েকে ডেকে পাঠালেন তিনি, ‘বলো তো, মা, কতটা ভালোবাস তুমি আমাকে?’ জানতে চাইলেন তিনি।

জীবনকে যতটা ভালোবাসি, ততটাই ভালোবাসি তোমাকে।

‘খুব ভালো লাগল শুনে’, জমিদার হাসিমুখে বললেন।

এবার ডাকলেন মেজো মেয়েকে, ‘তুমি কতটা ভালোবাস আমাকে, বলো তো, মা?’

‘সেটা বলা অত সহজ!’ মেয়ে উত্তর দিল। ‘জগতে সবার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসি, বাবা।’

জমিদারের বুক আনন্দে ভরে উঠল। ‘ভারি খুশি হলাম শুনে’, বললেন তিনি।

সবশেষে ছোট মেয়েকে কাছে ডাকলেন। এই মেয়ে তার সবচেয়ে আদরের। খুব ছোটবেলায় মা-হারা হয়েছে সে, তারপর শুধু বাবার স্নেহেই দিনে দিনে বড় হয়ে উঠেছে। বোনদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে সুন্দরী। সাগরের মতো নীল তার চোখ, মাথায় সোনালি চুলের রাশি।

‘বলো তো, মামণি’, জমিদার হাসিমুখে জানতে চাইলেন, ‘কেমন ভালোবাস তুমি আমাকে?’

‘সে কথা কী করে বোঝাই, বাবা?’ ছোট মেয়ে বলল। ‘তোমাকে আমি ভালোবাসি যেমন টাটকা মাংস ভালোবাসে লবণকে '

সওদাগরের মুখের হাসি দপ্‌ করে নিভে গেল। এ কেমন কথা বলছে তার অতি আদরের ছোট মেয়ে! রাগে-দুঃখে তিনি যেন অন্ধ হয়ে গেলেন।

‘মোটেই ভালোবাস না তুমি আমাকে। বুঝতে পারছি।’

কঠিন স্বরে বলে উঠলেন জমিদার। ‘এ বাড়িতে তোমার জায়গা নেই। আজই তুমি চলে যাবে যেখানে খুশি। কাল সকালে তোমার মুখ আমি যেন আর না দেখি।‘

মলিন মুখে ছোট মেয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। নিজের অসংখ্য পোশাকের ভেতর থেকে মাত্র তিনটি পোশাক বেছে নিল সে। সেগুলোর একটা সূর্যের মতো ঝলমলে সোনালি। আরেকটা চাঁদের মতো চকচকে রুপালি। তৃতীয়টা আকাশভরা তারার মতো ঝকমকে উজ্জ্বল।

এমন মিহি আর আশ্চর্য ধরনের সেই পোশাকগুলো যে, তিনটি পোশাকই সে ভাঁজ করে অনায়াসে তিনটি বাদামের খোলার ভেতর পুরে নিতে পারল।

এবারে সে পরে নিল ফারের তৈরি একটা পুরোনো মলিন টুপিওয়ালা আলখেল্লা। মাথার চুল থেকে একেবারে পা পর্যন্ত তাতে ঢাকা পড়ে গেল।

সবশেষে নিজের হাতে-মুখে ঝুলকালি মেখে নিল, যাতে কেউ তাকে না চিনতে পারে। তারপর একটা ছোট থলিতে বাদামের খোলাগুলো পুরে নিয়ে সবার অলক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে বাবার প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।

অনেক রাত পর্যন্ত হেঁটে চলল জমিদারকন্যা যেদিকে দুচোখ যায়। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তখন প্রকাণ্ড একটা গাছের গুঁড়ির খোড়লের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে সে-দেশের রাজকুমার শিকারে বেরিয়েছে। তার সঙ্গের শিকারিরা শিকারের সন্ধানে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ গাছের খোড়লের মধ্যে ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল।

শিকারিদলের সঙ্গে ছিল কয়েকটা কুকুর। সেগুলোর ডাকে জমিদারকন্যার ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ার্ত চোখ মেলে চেয়ে রইল সে লোকগুলোর দিকে।

‘কে তুমি?’ একজন শিকারি জানতে চাইল।

‘আমি এক অভাগিনী। কোথাও আমার যাবার জায়গা নেই।’ করুণ স্বরে বলল জমিদারের মেয়ে। ‘আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো। সব রকম কাজ করতে জানি আমি।’

মেয়েটার মলিন বেশবাস আর আলুথালু চেহারা দেখে শিকারিদের মায়া হলো।

‘ঠিক আছে, আলুথালু মেয়ে’, বলল একজন, ‘চলো আমাদের সঙ্গে—রাজপ্রাসাদের পাকশালায় কাজ করবে।’

প্রাসাদে ঠাঁই পেল জমিদারকন্যা। তাকে থাকতে দেয়া হলো সিঁড়ির নিচে একটা ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরিতে। হতশ্ৰী দীনহীন একটা মেয়ের জন্য এ-ই তো যথেষ্ট, ভাবল প্রাসাদের লোকেরা।

রান্নাঘরে সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে জমিদারের মেয়ে। পানি আনে, কাঠ আনে, চুলার আগুন জ্বেলে রাখে, ছাই ফেলে, থালাবাসন মাজে। রাতের বেলা নিজের ছোট্ট অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে প্রায়ই সে কেঁদে সারা হয়। নিজের পরিচয় দেয়া তো দূরের কথা, কাউকে সে নিজের নামও বলেনি। প্রথম দিন থেকেই সবাই তাকে ডাকে 'আলুথালু’ বলে।

একদিন জমিদারকন্যা শুনতে পেল, রাজপ্রাসাদে মস্ত এক নাচের আসর হবে। আরও শুনল, দাসদাসী, ভৃত্য-পরিচারকেরা ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে বড় মানুষদের নাচ দেখতে পারবে।

সন্ধ্যায় দাসদাসীরা সবাই দল বেঁধে যাওয়া শুরু করল। আলুথালুকেও তারা সঙ্গে নিতে চাইল। কিন্তু ছদ্মবেশী জমিদারকন্যা বলল, ‘আমি ভারি ক্লান্ত। যেতে পারব না। আমি বরং ঘরে শুয়ে থেকে বিশ্রাম নেব।’

কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল জমিদারের মেয়ে। পরনের মলিন পোশাক ছেড়ে ফেলে স্নান করে হাত-মুখের ঝুলকালি দূর করল। থলি থেকে একটা বাদামের খোলা নিয়ে সেটা খুলে বের করল তার সূর্যের মতো ঝলমলে সোনালি পোশাক। সেই পোশাক পরে সেজেগুজে নাচের আসরে গিয়ে হাজির হলো।

সেখানে কেউ তাকে চিনতে পারল না। দেখা গেল, আসরে উপস্থিত সব মেয়ের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে সুন্দরী—তার মতো সুন্দর পোশাকও সেখানে আর কারও নেই।

তরুণ রাজকুমার ছিল আসরের মধ্যমণি। রূপবতী জমিদারকন্যাকে দেখামাত্র সুদৰ্শন রাজকুমার তাকে ভালোবেসে ফেলল। তার সঙ্গে ছাড়া আর কারও সঙ্গে রাজকুমার নাচলই না।

নাচের আসর শেষ হতে যখন আর বেশি বাকি নেই, সে সময় ছোট্ট অন্ধকার ঘরে ফিরে এলো। হাতে-মুখে আবার আগের মতো ঝুলকালি মেখে টুপিওয়ালা মলিন আলখেল্লায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত মুড়ে নিল। তারপর বিছানায় এমনভাবে চোখ বুজে শুয়ে রইল যেন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে।

একটু পরে দাসদাসীরা বাড়ি ফিরে এলো। আলুথালুর ঘরে উঁকি দিয়ে তারা ভাবল, ‘আহা, বেচারা কেমন ঘুমাচ্ছে--কিছুই সে দেখতে পেল না।’

পরদিন সকালে দাসদাসীরা তাকে নাচের আসরের কত গল্প শোনাল, ‘গেলে ভালো করতে তুমি, আলুথালু।’

‘কেন, কী হতো গেলে?’ জমিদারকন্যা বলল।

‘রূপবতী এক মেয়ে এসেছিল নাচের আসরে, সবার সেরা সুন্দরী সে—আমাদের রাজকুমার তো তার দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারে না!'

‘তাই নাকি!’ চোখ কপালে তুলে বলল আলুথালু, ‘আহা, একবার তাকে দেখতে পেলে হতো!’

‘শোনো, আজ রাতেও আবার নাচের আসর হবে, হয়তো সে আসবে।’

সন্ধ্যায় সবাই চলে যেতেই ফারের আলখেল্লা ছেড়ে ফেলল সে। স্নান করে বাদামের খোলা থেকে চাঁদের মতো চকচকে রুপালি পোশাকটা বের করে পরে নিল। তারপর সেজেগুজে হাজির হলো নাচের আসরে।

আবারও রাজকুমার শুধু তারই সঙ্গে নাচল—মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল তার দিকে। কিন্তু নাচ শেষ না হতেই সুযোগ বুঝে একসময় ফিরে এলো।

দাসদাসীরা যখন ফিরল তখন সে ঘুমের ভান করে বিছানায় শুয়ে আছে। পরনে সেই বিদঘুটে ফারের পোশাক, হাতে-মুখে ঝুলকালি।

পরদিন দাসদাসীরা আবার তাকে নাচের আসরের গল্প বলতে লাগল, ‘কাল তোমার যাওয়া উচিত ছিল, আলুথালু, সেই মেয়েটাকে তো দেখতে পেলে না। কালও সে এসেছিল। কী অপরূপ সুন্দরী—আমাদের রাজকুমার তো চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গিয়েছিল!'

‘আজ সন্ধ্যায় চলো আমাদের সঙ্গে। আজও নাচের আসর হবে, হয়তো আজও সে আসবে।’

কিন্তু সন্ধেবেলা দাসদাসীরা যখন নাচ দেখতে যাওয়ার আয়োজন করছে, জমিদারের মেয়ে তখন বলল, ক্লান্তিতে নড়তে পারছে না সে, তাই একটু শুয়ে থেকে বিশ্রাম নেবে।

সবাই চলে যেতেই সে তাড়াতাড়ি পরনের মলিন পোশাক ছেড়ে স্নান সেরে নিল। তারপর বাদামের খোলা থেকে তার আকাশভরা তারার মতো ঝকমকে উজ্জ্বল পোশাকটা বের করে পরে সুন্দর করে সেজে নাচের আসরে গিয়ে উপস্থিত হলো।

রাজকুমার যেন তারই অপেক্ষায় ছিল। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ। দুজন একসঙ্গে নাচল অনেকক্ষণ ধরে। রাজকুমারের মুগ্ধ দৃষ্টি জমিদারকন্যার মুখের ওপরই আটকে রইল।

নাচতে নাচতে রাজকুমার একসময় অচেনা মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করল, জানতে চাইল কোথায় তার বাস। কিন্তু জমিদারকন্যা কিছুই বলল না।

কিছুক্ষণ পর দুজন ঘরের এক কোণে এসে পড়ল। রাজকুমার নিজের আঙুল থেকে একটা আংটি খুলে উপহার দিল জমিদারকন্যাকে।

‘তোমার সঙ্গে দেখা না হয় যদি, আমি বাঁচব না।’ নিচু স্বরে বলল সে।

আবারও জমিদারকন্যা নাচ শেষ হওয়ার আগেই সবার অলক্ষ্যে নিজের ছোট্ট অন্ধকার ঘরে ফিরে এলো।

দাসদাসীরা যখন ফিরল তখন সে আগের মতোই আলুথালুর বেশে ঘুমের ভান করে পড়ে রয়েছে।

‘কাল রাতে নাচ দেখতে না গিয়ে ভারি ভুল করেছ তুমি, আলুথালু।’ পরদিন দাসদাসীরা বলল তাকে, ‘এখন আর চাইলেও ওই সুন্দরী মেয়েটাকে দেখতে পাবে না—কারণ, নাচের আসর আর হবে না।’

আহা, একদিন যদি তাকে দেখে আসতাম তোমাদের সঙ্গে গিয়ে! দুঃখ-দুঃখ গলায় জমিদারকন্যা বলল।

এদিকে নাচের আসরের সেই পরমা সুন্দরী কন্যার সন্ধান পাওয়ার জন্য রাজকুমার অস্থির হয়ে উঠেছে। দিকে দিকে লোক পাঠাল সে, সব জায়গায় খোঁজ নিল। নিজেও সে গেল নানা শহরে ও নানা রাজ্যে, যাকে সামনে পেল তাকেই জিজ্ঞেস করল—কিন্তু অচেনা সেই মেয়ের কথা কেউ কিছু বলতে পারল না।

ভয়ানক মুষড়ে পড়ল রাজকুমার। দিন দিন তার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকল। শেষ পর্যন্ত একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল সে।

রাজা-রানির কানেও গেল সব কথা, তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত রইল না।

একদিন অসুস্থ রাজকুমারের জন্যে রাঁধুনি পরিজ তৈরি করতে বসেছে। এমন সময় আলুথালু পাকশালায় ঢুকল, ‘কী করছ?’ জিজ্ঞেস করল আলুথালু।

‘ছোট মনিবের জন্য একটু পরিজ তৈরি করছি’, রাঁধুনি উত্তর দিল।

‘সেই অজানা-অচেনা মেয়ের জন্য তিনি তো মরতে বসেছেন।’

‘দাও, আমি তৈরি করে দিই’, বলল আলুথালু।

রাঁধুনি আপত্তি করল না। যত্ন করে পরিজ তৈরি করল আলুথালু। রুপার বাটিতে ঢালল। তারপর রাঁধুনির চোখ এড়িয়ে বাটির ভেতর রাজকুমারের উপহার দেয়া আংটিটা আস্তে করে ফেলে দিল। পরিজের বাটি নিয়ে রাঁধুনি চলল ওপরতলায় রাজকুমারের শয়নঘরে।

একটুখানি পরিজ মুখে তুলতেই রাজকুমারের মনে হলো এমন সুস্বাদু পরিজ অনেক দিন খায়নি। খেতে খেতে সবটা পরিজ খেয়ে ফেলল সে। আর তারপরই তার চোখে পড়ল বাটির তলায় চকচক করছে একটা আংটি।

সেটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে রাজকুমারের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কোনো সন্দেহ নেই, এই আংটিটাই সে নাচের আসরে অজানা সেই রূপবতী মেয়েকে উপহার দিয়েছিল।

‘রাঁধুনিকে ডেকে আনো’, হুকুম দিল রাজকুমার।

রাঁধুনি এলো।

‘কে তৈরি করেছে এই পরিজ?’ রাজকুমার জানতে চাইল।

‘আমি’, ভয়ে ভয়ে বলল রাঁধুনি।

তার দিকে স্থির চোখে তাকাল রাজকুমার, ‘না, তুমি তৈরি করোনি।’ গম্ভীরভাবে বলল সে। ‘সত্যি করে বলো কে তৈরি করেছে এ পরিজ—আমি তোমাকে কোনো সাজা দেব না।’

‘আলুথালু, হুজুর।’ রাঁধুনি ঢোক গিলে বলল।

‘সে আবার কে?’ বলল বিস্মিত রাজকুমার। ‘তাকে বলো এখানে আসতে।’

এলো আলুথালু।

‘আমার জন্য পরিজ তুমি তৈরি করেছ?’ জানতে চাইল রাজকুমার।

‘হ্যাঁ’, আলুথালু বলল।

‘এই আংটি তুমি কোথায় পেয়েছ?’

‘যে আমাকে দিয়েছে তার কাছ থেকে।’

রাজকুমারের মুখে কিছুক্ষণ কথা সরল না, ‘কে দিয়েছে তোমাকে?’ একটু পরে ধীরে ধীরে বলল সে। ‘তুমি কে?’

মুচকি হেসে জমিদারকন্যা মাথা থেকে ফারের টুপি সরিয়ে ফেলল। অমনি তার সুন্দর মুখের দুই পাশ ঘিরে কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়ল সোনালি চুলের রাশি।

অবাক হয়ে চেয়ে রইল রাজকুমার—এ তো সত্যি সেই চেনা মুখ মনে হচ্ছে!

তার আকাশভরা তারার মতো ঝকমকে উজ্জ্বল পোশাক পরে এসে সামনে দাঁড়াল, তখন আর তাকে চিনতে রাজকুমারের বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না।

বহুদিন ধরে যাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে, তাকে হঠাৎ সামনে দেখতে পেয়ে আনন্দে অধীর হয়ে উঠল রাজকুমার। কিছুদিনের মধ্যেই রাজকুমার সুস্থ হয়ে উঠল। ঠিক হলো, খুব শিগগিরই মহাসমারোহে দুজনের বিয়ে হবে।

কাছের ও দূরের অসংখ্য লোকজনকে বিয়ের উৎসবে নিমন্ত্রণ করা হলো। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে রইলেন আলুথালুর বাবাও। আলুথালু কিন্তু তখনও কাউকে বলেনি কোথায় তার বাড়ি, কী তার পরিচয়। তার অনিচ্ছা বুঝতে পেরে রাজকুমার এ নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করতে সবাইকে বারণ করে দিয়েছে।

বিয়ের উৎসবের দুদিন আগে আলুথালু গোপনে রাঁধুনির সঙ্গে দেখা করল। বলল সে, ‘শোনো রাঁধুনি, বিয়ের ভোজের প্রত্যেকটা খাবার রান্না করবে লবণ বাদ দিয়ে। সবকিছুই দেবে, কিন্তু লবণ দেবে না এক দানাও।’

‘সে কী কথা!’ রাঁধুনি আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘খাবার যে তাতে একেবারে বিস্বাদ হয়ে যাবে—কোনো খাবারই কেউ মুখে তুলতে পারবে না!’

‘তা হোক’, বলল আলুথালু, ‘আমি যা বললাম তা-ই করবে। আর সাবধান, এ নিয়ে কাউকে কিছু বলবে না।’

‘ঠিক আছে, তা-ই হবে’, রাঁধুনি বলল নিরুপায় হয়ে।

বিয়ের দিন এসে পড়ল। লোকজন অতিথি-অভ্যাগতের ভিড়ে রাজপুরী গমগম করছে। খুব জাঁকজমক আর ধুমধামের সঙ্গে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের অনুষ্ঠানের পর অতিথিরা সবাই ভোজ খেতে বসেছেন। কিন্তু খাবার মুখে দিতেই সবার মুখ বাঁকা হয়ে গেল। লবণের লেশমাত্র নেই—এ কী জঘন্য যাচ্ছেতাই খাবার! অপ্রস্তুত হয়ে সবাই হাত গুটিয়ে বসে রইলেন।

অতিথিদের মধ্যে আলুথালুর বাবাও খেতে বসেছিলেন। এটা মুখে দিলেন, ওটা চেখে দেখলেন–কিছুই খেতে পারলেন না। তিনিও বুঝলেন, একটুও লবণ দেয়া হয়নি কোনো খাবারে, তাই সব এমন বিষাদ।

মাংসের একটা টুকরায় জিভ ছুঁইয়ে সেটা আবার থালায় নামিয়ে রেখে চুপচাপ বসে ছিলেন জমিদার। হঠাৎ তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। দুচোখ ভরে উঠল জলে।

‘কী ব্যাপার! কী হয়েছে আপনার?’ রাজকুমার এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইল।

‘হায়!’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন জমিদার, ‘আমার একটা অতি আদরের মেয়ে ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে আমাকে কতখানি ভালোবাসে। সে বলেছিল, ‘তোমাকে আমি ভালোবাসি যেমন টাটকা মাংস ভালোবাসে লবণকে।’

সে কথা শুনে তাকে আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম—ভেবেছিলাম সে আমাকে একটুও ভালোবাসে না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, সব মেয়ের মধ্যে সে-ই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। কিন্তু সে বুঝি আজ আর বেঁচে নেই।

'না, বাবা, এই তো সে বেঁচে আছে’, বলে উঠল আলুথালু। এগিয়ে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল সে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন জমিদার। দুহাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। এবার তার দুচোখ থেকে গড়িয়ে নামল আনন্দের অশ্রু।

জমিদারকন্যার আশ্চর্য কাহিনি শুনে সবার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সেই সঙ্গে রাজপুরী আবার উৎসবমুখর হয়ে উঠল। নতুন করে ভোজের আয়োজনও শুরু হলো তখনই।

এ বিভাগের আরো খবর