গ্রামে এক লোক বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করত। তার সাথে থাকত সিরকো নামের এক কুকুর। সিরকো অনেক বছর ধরে তার মনিবের সাথে আছে। বয়সের ভারে সে এখন আগের মতো বাড়ি পাহারা দিতে পারে না। কাজ করতে না পারার শাস্তি হিসেবে একদিন সিরকোকে মনিব দিল বাড়ি থেকে বের করে।
‘কত্তগুলো বছর আমি মনিবের খেদমত করেছি। এখন আমার বয়স হয়েছে। দয়ামায়ার ধার না ধেরে, মনিব আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল! মানুষ এত্ত নিষ্ঠুর!’
এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনে সিরকো পথ চলছিল। হঠাৎ কোত্থেকে এক নেকড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘বলি এভাবে ঘোরাফেরা করছো, তোমার কাহিনিটা কী বলো দেখি বাপু।’ কৌতূহল নিয়ে নেকড়েটা সিরকোর কাছে এগিয়ে এলো। হাজার হোক জ্ঞাতিসম্পর্কীয় হালকা-পাতলা একটা আত্মীয়তা তো আছে কুকুর জাতটার সাথে। হয়তো সেটার তাগিদেই সিরকোকে অনেকক্ষণ ধরে এলোপাতাড়ি ঘুরতে দেখে নেকড়ের কেমন একটু মায়াই হয়।
‘আমি আর কাজে লাগছি না দেখে মনিব আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কোত্থাও যাওয়ার নেই।’ দুঃখী দুঃখী গলায় উত্তর দিল সিরকো।
শুনে নেকড়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। যেভাবে বলব সেভাবে যদি কাজটা করতে পারো তবে নিশ্চিত থাকো, মনিব তোমাকে আবারও বাড়িতে আশ্রয় দেবে।’
‘দয়া করো নেকড়ে ভায়া! আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বাতলে দাও।’ সিরকো প্রায় কেঁদে কঁকিয়ে উঠল, ‘এ উপকারটা করলে বিনিময়ে আমিও প্রতিদান দেবার চেষ্টা করব।’
‘বেশ, শোন মন দিয়ে। শিগগিরই ফসল তোলার জন্য তোমার মনিব আর তার স্ত্রী মাঠে যাবে। স্বামীর কাজে সাহায্য করতে মনিবের স্ত্রীও তাদের বাচ্চাটাকে খড়ের গাদায় ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। তোমাকে কিন্তু বাচ্চাটার আশপাশেই ঘাপটি দিয়ে থাকতে হবে, যেন আমার বুঝতে সুবিধা হয় বাচ্চাটা ঠিক কোথায় ঘুমোচ্ছে। মনিব আর তার স্ত্রীর ব্যস্ততার সুযোগে আমি সেখানে গিয়ে বাচ্চাটাকে খপ করে মুখে তুলে নেব। তুমি তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটাকে আমার মুখ থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে। আমাকে একটু ভয় দেখাবার ভান ধরবে। আমিও ভয় পেয়েছি এমন একটা ভান করে মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ফেলে পালিয়ে যাব।‘
মাঠের ফসল পেকে উঠলে যথাসময়ে সিরকোর মনিব বউ-বাচ্চা নিয়ে মাঠে গেল। মাঠের কাছাকাছি জায়গায় বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে ফসল তোলার কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে শুরু করল স্ত্রী।
ওদিকে নেকড়ের কথামতো খড়ের গাদার ওপাশে ঘাপটি মেরে থাকা সিরকোর উঁকি দেয়া কান দেখে নেকড়ের বুঝে নিতে দেরি হলো না বাচ্চাটা কোথায়। ফন্দি মাফিক নেকড়ে সেখানে গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে দিল দৌড়। নেকড়ের পিছু পিছু ঘেউ ঘেউ করতে করতে সিরকোও ছুটল। এমন ভয়ংকর কাণ্ড দেখে মনিব সব ভুলে সিরকোকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘ধর ওকে সিরকো!’
সিরকো ছুটে গিয়ে নেকড়ের মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিয়ে মনিবকে ফিরিয়ে দিল। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে মনিব সিরকোকে এক টুকরো রুটি আর গোশত খেতে দিল। সন্ধ্যায় বাড়ির পথে রওনা দেয়ার সময় সিরকোকেও সঙ্গে নিয়ে নিল।
বাড়ি ফিরেই মনিব সিরকোকে গরম গরম খাবার দিল। সেই খাবার হুড়োহুড়ি করে খেতে গিয়ে সিরকোর জিভ গেল পুড়ে। সবাই সেটা নিয়ে হাসাহাসি করল।
বাচ্চাকে বাঁচানোর পুরস্কারস্বরূপ সিরকো আবার মনিবের বাড়িতে আশ্রয় পেল। বন্ধু নেকড়ের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল, সে কথাটা সিরকো ভুলে যায়নি। কীভাবে বন্ধুর উপকারের প্রতিদান দেয়া যায় সেটা নিয়ে সে ভাবতে লাগল।
মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দারুণ সব খাবারের অয়োজন হয় একদিন। সিরকো মাঠে গিয়ে নেকড়েকে দাওয়াত দিয়ে আসে, ‘শোনো ভাই, আগামী রোববার সন্ধ্যায় তুমি আমাদের সবজিবাগানে এসে ঘাপটি দিয়ে বসে থেকো। সময়মতো এসে তোমাকে চুপিচুপি ভেতর বাড়িতে নিয়ে যাব। খাসা আয়োজন হয়েছে খাওয়াদাওয়ার। কবজি ডুবিয়ে খেয়ো ভায়া! ভরপেট খাইয়ে তোমার দয়ার প্রতিদান দিতে পারব আশা করি। ‘
সিরকোর কথামতো বিয়ের দিন সবজিবাগানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে নেকড়ে। সিরকো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি নেকড়েকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। তারপর টেবিলের তলায় লুকিয়ে রাখে। অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখা মজাদার সব খাবার থেকে কিছু খাবার নিয়ে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকা নেকড়েকে দেয়।
অল্প সময়ের মধ্যেই নেকড়ে গপাগপ সাবাড় করে ফেলে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সিরকো আবারও খাবার নিয়ে আসে। আবারও সে গপাগপ করে সবটা খেয়ে ফেলে। নেকড়েকে খাবার জোগাতে গিয়ে একপর্যায়ে সিরকোর পিঠেই অতিথিদের পিটুনি পড়তে যাচ্ছিল।
মনিব সেটা দেখে তাদের বিরত করে বলে, ‘দয়া করে ওকে কেউ মারবেন না। আমার বাচ্চাটাকে নেকড়ের মুখ থেকে বাঁচিয়ে সিরকো আমাদের কৃতজ্ঞতায় বেঁধে ফেলেছে। ওকে এ পরিবারেরই একজন সদস্য হিসেবে দেখার অনুরোধ থাকল সবার প্রতি।’
মনিবের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো খাবার চাখার অনুমতি পেয়ে সিরকোর তো পোয়াবারো। সে ভালো ভালো গোশতের টুকরো, পিঠা, কেক, মিষ্টি সমানে টেবিলের তলায় চালান দিতে থাকল। এত এত খেয়ে নেকড়েটার শুধু পেটই ভরে উঠল না, মনটাও খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেল। খুব খুশিতে থাকলে নেকড়ের আবার গান গাইবার ঝোঁক চাপে।
যেই না নেকড়ে সুর তুলেছে, সুরের বদলে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বেসুরো চিৎকারে অতিথিরা চমকে ওঠে। আতঙ্ক নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। অনেকেই নেকড়েকে মারবে বলে লাঠিসোটা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। মতিগতি সুবিধার না দেখে সিরকো নিজেই লাফ দিয়ে নেকড়ের ওপর গিয়ে পড়ে। ভাবখানা তার এমন যে ব্যাটাকে আজ মেরে আর আস্ত রাখবে না!
ওদিকে রাগে-ভয়ে অস্থির অতিথিদের শান্ত হবার অনুরোধ করে মনিব বলে, ‘সবাই শান্ত হন। কেউ নেকড়েকে মারতে যাবেন না, তাতে সিরকোর পিঠেই ঘা পড়ার আশঙ্কা আছে। বদের হাড্ডি নেকড়েকে শায়েস্তা করতে সিরকো একাই যথেষ্ট।’
সিরকো নেকড়েকে টানতে টানতে মাঠে নিয়ে গেল। বলল, ‘একবার তুমি আমার উপকার করেছিলে। আজ সেই উপকারের প্রতিদান দিলাম বন্ধু। তুমি পালাও জলদি।’
এরপর, দুই বন্ধু একে অন্যকে বিদায় জানিয়ে আলো ঝলমল বিয়েবাড়ির দিকে একজন, অন্যজন মাঠ পেরিয়ে দূরের বনের দিকে হাঁটা দেয়।