১
স্কুলে টিফিনের ফাঁকে কিছুক্ষণ দৌড়োদৌড়ি করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে অক্ষয়। ক্লাস টু তে পড়ে সে এখন। স্কুলের আনাচে-কানাচে একদম মুখস্ত।
দেয়ালটা নোংরা হলেও এর মাঝেই ইটের টুকরো দিয়ে ছবি আঁকে অক্ষয়। মানুষের ছবি, প্রকৃতির ছবি, পশুপাখির ছবি।
তবে লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি আঁকতে হয় অক্ষয়কে। না হলে স্কুলের পিয়ন দেখে ফেললে হেডস্যারকে বিচার দেবে।
অক্ষয়ের মজাই লাগে লুকোচুরি করে ছবি আঁকতে। স্কুল ভালো লাগে তার। সে স্কুলে ছবি আঁকা শেখে, অংক শেখে, বাংলা-ইংরেজি শেখে। কিন্তু তার পরীক্ষা দিতে একদম ভালো লাগে না। তবে পরীক্ষা শেষ হলে অনেক মজা লাগে।
স্কুলে সে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্যানে করে যায় আসে। অনেক মজা হয়। এই তো সেদিন পিপলুর সঙ্গে চকলেট বাজি ধরেছে।
পিপলু বলেছিল, একটা এপিসোডে স্কুবি নাকি হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অক্ষয় বলল, না, ও নিজে থেকে লুকিয়ে ছিল। শেষে দেখা গেল অক্ষয়ের কথাই ঠিক। সে-ই পেল চকলেট।
বাসায় এসে অক্ষয় কার্টুন দেখে। তার প্রিয় কার্টুন ‘স্কুবি ডু’ আর ‘ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট’। লেগো খেলা তার পছন্দ। রং-বেরঙের লেগো দিয়ে সে বাড়ি বানায়।
অক্ষয়দের বাসাটা চার তলায়। জানালা দিয়ে নিচে অনেক টিনের চালাঘর দেখা যায়। বৃষ্টি হলে চালের ওপর বৃষ্টির আওয়াজ তার খুব ভালো লাগে।
রুমে একটা চার চাকার সাইকেল আছে। বিকেল হলে ছাদে সাইকেল চালায়। চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝে তার পিপলুর কথা মনে পড়ে। পিপলুর খুব ইচ্ছে সাইকেল চালানোর। কিন্তু ওর বাবা এখনও কিনে দেয়নি।
অক্ষয়ের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছবি আঁকা। এ পর্যন্ত সে বেশ কয়েকটা মেডেল জিতেছে কম্পিটিশনে। ঘরের দেয়ালে তার আঁকা অনেক ছবি লাগানো। সবচেয়ে প্রিয় ছবিটা তার বিছানা বরাবর। একটি ছেলে নদীর ধারে গাছের নিচে বসা। ছেলেটিকে সে নিজেকে ভেবেই এঁকেছে।
অক্ষয়ের খুব ইচ্ছে এ রকম একটা জায়গায় গিয়ে বসবে। বাবা বলেছে, গ্রামে এ রকম জায়গা আছে; নিয়ে যাবে তাকে। কিন্তু কবে যে নিয়ে যাবে!
রাতে মাঝে মাঝে মা তাকে পড়ায়, হোমওয়ার্ক করায়।
১০টা বাজলেই অক্ষয় ঘুমিয়ে যায়। এরপর সে আর চোখ খোলা রাখতেই পারে না। তখন ঢুলুঢুলু চোখ আয়নায় দেখে নিজেরই হাসি পায়।
অক্ষয়ের বাসার কাছেই একটা ফাঁকা জায়গা আছে। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায়ই সে জায়গাটা দেখে। এখানে গত বার পূজার মণ্ডপ বসেছিল। কিন্তু সে বার মেসোর বাড়িতে থাকায় সে দেখতে পারেনি। এবার আসবে এই মণ্ডপে।
দেখতে দেখতে ক্লাস টুর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল। রেজাল্ট হলেই থ্রিতে উঠবে। তার চেয়ে বড় কথা, এখন ছুটি। অনেক মজা লাগছে অক্ষয়ের। সে শুধু এখন ছবি আঁকবে। অনেক দৃশ্য জমে আছে মাথায়।
কিন্তু কিছুদিন পর একদিন বাবা হঠাৎ বললেন, ‘শোন অক্ষয়, তুই আপাতত থ্রিতে পড়বি না। কোচিং করে এক বছর পর ভালো স্কুলে ভর্তি হয়ে আবার পড়বি।’
অক্ষয় এ কথা শুনে খুব চমকে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কেন বাবা? আমি তো স্কুলে পড়ছি। তাহলে আবার অন্য স্কুল কেন?’
বাবা বললেন, ‘বেশি বুঝিস না। তোর মাসি-পিসির ছেলেরা সব ভালো জায়গায় পড়ে, তোকেও পড়তে হবে। যা, ঘরে যা এখন।’
নিজের ঘরে এসে অক্ষয় কেঁদে ফেলল। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল। তার মাথার সব দৃশ্য যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
দুই দিন পর মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে টিসি আনতে গিয়ে সে তার প্রিয় দেয়ালের কাছে এলো। এখানে অক্ষয়ের কত ছবি আঁকা। একটা ছবিতে এক ছেলের হাত মুছে গিয়েছিল। সেটা আবার ঠিক করে দিলো।
২
এরপর বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে। অক্ষয় আর স্কুলে যায় না, নিয়মিত বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে যায়। বাসাতেও এক স্যার এসে পড়িয়ে যান।
এই স্যারকে ভয় লাগে তার। পড়া না পারলে স্কেল দিয়ে হাতে মারেন। এর চেয়ে মায়ের কাছে পড়তেই ভালো লাগত। কিন্তু এখন আর মা পড়ান না।
কোচিংয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই সে তার ভ্যানগাড়ির বন্ধুদের দেখে। পিপলুও থাকে সেখানে। ওরা অক্ষয়কে দেখে হাত নাড়ে। কিন্তু ওদের দেখে মন খারাপ হয়। তাই সে আর ওদের দিকে তাকাত না।
কোচিংয়ে অক্ষয়ের কোনো বন্ধু নেই। দুই-এক জনের সঙ্গে শুধু কথা হয়। ওখানে সবাই চুপচাপ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকে। কেউ খেলে না।
সারা দিন কোচিং সেরে বাসায় এসে অক্ষয় আর কার্টুন দেখার সময় পায় না। তার প্রিয় কাজ ছবি আঁকা? গত কয় মাসে সে একটা ছবিও আঁকেনি। সাইকেলটা না চালাতে চালাতে চেইনে জং ধরেছে। ছাদেও যাওয়া হয় না অনেক দিন।
রাতে প্রায়ই ঘুমাতে ঘুমাতে ১২টা বেজে যায়। হোমওয়ার্ক থাকে অনেক। এখন আর অক্ষয় আগের মতো আয়নায় তাকিয়ে তার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে না। কেমন যেন কালো দাগ পড়ে গেছে চোখের নিচে। তাই আর দেখতে ভালো লাগে না।
৩
বর্ষাকাল এসে গেছে। ছাতা মাথায় দিয়ে কোচিংয়ে গেলেও প্রায় দিনই বৃষ্টির ছাঁটে গা ভিজে যায়। ভেজা গায়েই ক্লাস করে বাড়ি ফিরতে হয়।
কিন্তু কয়েক দিন ধরে অক্ষয় জ্বরের জন্য কোচিংয়ে যেতে পারছে না। শুরুতে হালকা জ্বর ছিল। তখন নাপা খেয়ে কোচিংয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে জ্বর বেড়ে যাওয়ায় বিছানা ছেড়েই আর উঠতে পারছে না।
জ্বরের ঘোরে কী সব বলে অক্ষয়। মাঝে মাঝে জং ধরা সাইকেলের চেনটা দেখে। নিজের আঁকা প্রিয় ছবিটা দেখে। এখন আবার খুব ইচ্ছা করে নদীর ধারে গাছের নিচে বসে থাকার।
সেদিন গলির ফার্মেসির ডাক্তার আঙ্কেল তার আঁকা ছবিটা দেখে বলেন, ‘বাহ, তুমি তো দারুণ আঁকো!’
শুনে অক্ষয়ের খুব ভালো লেগেছে।
এভাবে আরও কয়েক দিন গেল। অক্ষয়ের শরীর আরও খারাপ হয়েছে। ডাক্তার বলেছে নিউমোনিয়া। শেষে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। খুব শ্বাসকষ্ট। প্রায় সবসময় মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো থাকে।
অক্ষয় এটা খুব ভয় পায়। গত বছর দাদুমনির মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়েছিল। তার কয়দিন পরই দাদুমনি মারা যান।
হাসপাতালে তার বিছানার সামনের দেয়ালটা নোংরা। অক্ষয়ের ইচ্ছা করে ওই দেয়ালে ছবি এঁকে সুন্দর করে তুলতে। কিন্তু অক্ষয়ের সব শক্তি তো ক্ষয় হয়ে গেছে।
এদিকে পূজার সময়ও চলে এসেছে। কিন্তু এ বছরও তার সেই মণ্ডপ দেখা হলো না।
এভাবে আরও দুই দিন গেল। সকাল থেকে অক্ষয়ের রুমে ডাক্তার আর নার্সদের ভিড়। তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। মা দূরে কাঁদছেন। বাবা দরজা ধরে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছেন।
মণ্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ কানে আসছে। স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। পিপলুকে অক্ষয় তার সাইকেলটা দিয়ে দিতে চায়। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার আঁকা প্রিয় ছবিটা। অপলক চোখে সে তাকিয়ে দেখছে। নদীর ধারে, গাছের নিচে অক্ষয় বসে আছে।
ডাক্তার অক্ষয়ের মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেললেন। আলতো করে বন্ধ করে দিলেন চোখের পাতা।
বাইরে বৃষ্টি যেন বেড়ে গেছে। তুমুল বেগে আছড়ে পড়ছে মাটিতে, টিনের চালে।
লেখক: শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি