টুনটুনি আর টুনটুনা, টুনটুনা আর টুনটুনি।
এ ডাল হইতে ও ডালে যায় ও ডাল হইতে সে ডালে যায়,
সে ডাল হইতে আগডালে যায়, আগডাল হইতে লাগডালে যায়,
বেগুন গাছে যায়, লঙ্কা গাছে যায়, আম গাছে যায়, জাম গাছে যায়।
বল ত খোকাখুকুরা, আর কোন কোন গাছে যায়?
যে আগে বলিতে পারিবে তারই জিত।
কাঁঠাল গাছে, পেয়ারা গাছে, লিচু গাছে- আরও কত গাছে যায়।
শুধু কি ফলের গাছে, ফুলের গাছে যায় না?
কি কি ফুলের গাছে যায়?
আগে বলা চাই।
বুঝিয়াছি গোলাপ গাছে, টগর গাছে, হাসনাহেনার গাছে, কয়টা গাছের নাম করিব?
সব গাছে যায়।
সারাদিন কেবল ফুরুৎ ফুরুৎ।
এ গাছ ও গাছ করিয়া টুনটুনিদের জীবন কাটে।
একদিন টুনটুনা টুনটুুন করিয়া টুনটুনিকে বলে,
'দেখ্ টুনটুনি!
আমাদের যদি টাকা-পয়সা থাকিত তবে কি মজাই না হইত।
তোকে ভালমতো একখানা শাড়িও কিনিয়া দিতে পারি না।
আমি একখানা ভাল জামা-কাপড়ও পরিতে পারি না।
দেশে বড় লোকেরা কত রং-বেরঙের জামা-কাপড় পরে,
কেমন বুক ফুলাইয়া চলে।'
টুনটুনি বেশ গুমর করিয়া বলে,
'দেখ টুনটুনা!
শুনিয়াছি বনের মধ্যে নাকি সোনার মোহরভরা ঘড়া থাকে।
আমি যদি তার একটা কুড়াইয়া পাই, তবে বেশ মজা হয়।'
টুনটুনা বলে, 'সত্য কথাই বলিয়াছিস।
দেখ্ টুনটুনি!
বনের মধ্যে খুঁজিয়া পাতিয়া যেমন করিয়া হোক, একটা মোহরভরা কলস আমি বাহির করিবই।'
টুনটুনি বলে, 'তা তুমি বনের মধ্যে খুঁজিয়া খুঁজিয়া দেখ,
কোথায় মোহরভরা কলসি আছে;
আমি এদিকে বাসা আগলাই।'
টুনটুনা এ বনে খোঁজে, সে বনে খোঁজে।
বেতের ঝোপের আড়াল দিয়া,
শিমুল গাছের গোড়া দিয়া, হিজল গাছের তলা দিয়া,
কোথাও মোহরভরা কলসি পায় না।
খুঁজিতে খুঁজিতে খুঁজিতে গহন বনের ভিতর টুনটুনা এক কড়ার একটা কড়ি তালাশ করিয়া পাইল।
তাই ঠোঁটে করিয়া রোদে ঘামিতে ঘামিতে, বোঝার ভারে হাঁপাইতে হাঁপাইতে টুনটুনা ঘরে ফিরিয়া আসিল।
'টুনটুনি!
শিগগির আয়, শিগগির আয়!
দেখিয়া যা কি আনিয়াছি!'
এ বলিয়া ঠোঁট হইতে কড়িটি নামাইয়া টুনটুনা জোরে জোরে নিশ্বাস লইতে লাগিল।
টুনটুনি ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করে,
'বল না টুনটুনা!
কি হইয়াছে?'
টুনটুনা বলে, 'আগে আমাকে বাতাস কর, যা মেহনত করিয়া আসিয়াছি!'
টুনটুনি ব্যস্ত ত্রস্ত হইয়া দুইখানা পাখা নাড়িয়া নাড়িয়া টুনটুনাকে বাতাস করে।
কিন্তু কি যে একটা হইয়াছে জানিবার জন্য টুনটুনির মন কেবল উসখুস করিতে থাকে।
অনেকক্ষণ বাতাস করিয়া টুনটুনি বলে,
'বল না টুনটুনা! কি হইয়াছে?'
টুনটুনা বলে, 'আগে আমার হাত-পা ভাল করিয়া টিপিয়া দে, যা হয়রান হইয়া আসিয়াছি!'
টুনটুনি টুনটুনার পা টিপিয়া দেয়, পাখার পালকগুলিতে ঠোঁট গুঁজিয়া আদর করিয়া দেয়।
চুপটি করিয়া টুনটুনা যেন ঘুমাইয়া পড়ে।
কি যে একটা হইয়াছে শুনিবার জন্য টুনটুনির আর সয় না।
অনেক্ষণ পরে টুনটুনি টুনটুনাকে বলে,
'এবার বল না টুনটুনা কি হইয়াছে?'
টুনটুনা বলে, 'এমন একটা কিছু হইয়াছে যা কখনও হয় নাই।'
'কি হইয়াছে বল না টুনটুনা!'
টুনটুনির ধৈর্য আর মানিতে চাহে না।
টুনটুনা আরও খানিক দম লইয়া বলে,
'আমরা বড়লোক হইয়া গিয়াছি।'
'বড়লোক কেমন রে টুনটুনা!
বড়লোক হইলে কি হয়?'
টুনটুনি ঠোঁট উঁচাইয়া টুনটুনাকে জিজ্ঞাসা করে।
'তাই বুঝিতে পারিলি না?
এখন হইতে আমরা আর গাছের ডালে ডালে ফুলের খোঁজে ঘুরিব না, আকাশে উড়িয়া পোকা মাকড় ধরিব না, বেগুনগাছের কাঁটা খাইয়া ফুলের খোঁজেও বাহির হইব না।'
টুনটুনি চিৎকার করিয়া মরাকান্না কাঁদিয়া উঠে,
'ও মাগো, তবে আমাদের কি হইবে গো!
আমরা কি তবে খোঁড়া হইয়া যাইব নাকি গো?'
টুনটুনা বলে, 'দূর বোকা কোথাকার!
এখন আমরা বড়লোক হইয়াছি।
এখনও কি গাছের ডালে ডালে পরিশ্রম করিয়া বেগুন ফুলের খোঁজে যাইব?'
'তবে আমরা কি খাইব গো?'
টুনটুনি ডুকরাইয়া কাঁদিয়া ওঠে।
'আরে পোড়ারমুখী!
আর কি আমাদের খাওয়ার ভাবনা করিতে হইবে?'
টুনটুনা বলে।
টুনটুনি আরও একটু কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করে, 'তবে কেমন করিয়া খাইব?'
টুনটুনা এক কড়ার কড়িটি দেখাইয়া বলিল,
'এইটি দিয়া যা যা দরকার হয়, সব কিনিব।'
টুনটুনি বলে, 'সন্দেশ, রসগোল্লা, পানতোয়া, মিহিদানা সব কিনিতে পারিব? যা কিছু কিনিতে পারিব?
চকোলেট, লজেন্স, বিস্কুট?'
টুনটুনি লেজ নাচাইয়া জিজ্ঞাসা করে।
টুনটুনা উত্তর করে, 'হাঁ-হাঁ সবকিছু।'
টুনটুনি বলে, 'আমার গয়না, হাতের বালা, গলার মালা, কানের মাকড়ি?'
'সবকিছু এই এক কড়ার কড়ি দিয়া কিনিব, সাইকেল কিনিব, মোটরগাড়ি কিনিব, উড়োজাহাজ কিনিব।'
টুনটুনা বলে।
দুইজনে বসিয়া ভাবিয়া ঠিক করে, আর কি কি জিনিস তাহারা কিনিবে।
কি কি বই কিনিবে, হাওয়া বদল করিতে কোন কোন দেশে যাইবে।
বল ত সোনামণিরা!
তাহারা কি কি কিনিবে, কোন কোন দেশে যাইবে?
যে আগে বলিবে তারই জিত।
এক কড়ার কড়িটি বাসার মাঝখানে রাখিয়া টুনটুনি আর টুনটুনা তার চারদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচে আর গান করে-
'রাজার আছে যত টাকা,
মোদের আছে তত টাকা।'
তারা নায় না, খায় না, বেড়ায় না, শোয় না, ঘুমায় না, মনের আনন্দে সেই এক কড়ার কড়ির চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচে আর সেই গান গায়-
'রাজার আছ যত টাকা,
মোদের আছে তত টাকা।'
একদিন হইয়াছে কি?
সেই দেশের রাজা শিকারে চলিয়াছেন।
আগে পিছে মন্ত্রী-কোতোয়াল, লোক-লশকর, পেয়াদা-পাইক কেবল গমগম করিতেছে।
যাইতে যাইতে যাইতে তাহারা সেই টুনটুনি আর টুনটুনার বাসার কাছে আসিয়া উপস্থিত।
তখন রাজা শুনিতে পাইলেন, টুনটুনি আর টুনটুনা গান গাহিতেছে-
'রাজার আছে যত টাকা,
মোদের আছে তত টাকা।'
কি, এত বড় বুকের পাটা!
ছোট্ট এতটুকুন টুনটুনি, এক রত্তি টুনটুনা তারা গান গায়-
'রাজার আছে যত টাকা,
মোদের আছে তত টাকা।'
এতবড় রাজদ্রোহীদের সাজা হওয়া উচিত।
কোনদিন তারা রাজার রাজ্য আক্রমণ করিয়া বসে তার ঠিক কি!
তখন রাজা হুকুম করিলেন টিকটিকি পুলিশকে, 'দেখ ত কি আছে উহাদের বাসার মধ্যে।'
টিকটিকি পুলিশ টিক্টিক করিয়া রাজ্যের যত খবর আনিয়া রাজাকে শোনায়। রাজার হুকুম পাইতে না পাইতেই টিকটিকি পুলিশ টুনটুনির বাসায় যাইয়া দেখিয়া-শুনিয়া
সরেজমিনে তল্লাশি করিয়া রাজার কাছে আসিয়া নিবেদন করিল, 'মহারাজ!
টুনটুনি পাখির বাসায় এক কড়ার একটা কড়ি আছে।'
'কি, এক কড়ার একটা কড়ির জন্য টুনটুনির এত স্পর্ধা!
ওর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত কর।
ঘর-দোর যা কিছু আছে ভাঙিয়া ফেল।'
গোস্বায় রাজা কলাপাতার মতন কাঁপিতে লাগিলেন।
রাজার মুখ হইতে কথা বাহির হইতে না হইতে শহর-কোতোয়াল সৈন্যসামন্ত, দারোগা-পুলিশ লইয়া টুনটুনির বাসা ঘিরিয়া ফেলিল।
তারপর এক কড়ার কড়ি আনিয়া রাজকোষে জমা দিল, রাজার হাতি গিয়া টুনটুনি পাখির বাসা ভাঙিয়া পায়ের তলে পিষিয়া ফেলিল।
টুনটুনি পাখির গান তবু থামে না।
তারা এ ডাল হইতে ও ডালে, ও ডাল হইতে এ ডালে আসে, রাজার মাথার উপর দিয়া ফুরুৎ ফুরুৎ করিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়-
'রাজার আছে যত টাকা,
মোদের আছে তত টাকা।'
কি, এত বড় রাজদ্রোহী এক টুনটুনি পাখি!
স্পর্ধা ত কম না!
রাজাকে অপমান!
রাজা এবার রাগে জ্বলিয়া উঠিলেন।
'কে আছ, এখনই এই টুনটুনি পাখিকে বন্দী কর।'
রাজার হুকুম পাইয়া শহর-কোতোয়াল হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন।
সোয়ালক্ষ দারোগা, জমাদার কনস্টেবল, মার মার করিয়া উঠিলেন- সোয়ালক্ষ সিপাই সোয়ালক্ষ বন্দুক গুডুম করিয়া আওয়াজ করিলেন। সোয়ালক্ষ কামান কাঁধে করিয়া
সোয়ালক্ষ গদাইলশকর হন হন করিয়া ছুটিল।
কিন্তু কামানের গুড়ূম আর টুনটুনি পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ বন্দুকের ফুটুৎ ফুটুৎ আর টুনটুনি পাখির সুরুৎ সুরুৎ কিছুতেই থামে না।
এদিক হইতে যদি কামান গর্জায়, টুনটুনি পাখি ওদিকে চালিয়া যায়।
ওদিক হইতে যদি বন্দুক ফটকায় টুনটুনি পাখি এদিকে চলিয়া আসে।
এতটুকুন দু'টি পাখি!
গায়ে বন্দুকের গুলিও লাগে না, কামানের গোলা বারুদও আঘাত করে না। সোয়ালক্ষ দারোগা জমাদার রোদে ঘামিয়া উঠিলেন। সোয়ালক্ষ গদাইলশকর দৌড়াইতে
দৌড়াইতে হাপুস হুপুস হইয়া গেলেন; কিন্তু টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিলেন না।
রাজা তখন রাগিয়া মাগিয়া অস্থির।
প্রধান সেনাপতিকে ডাকিয়া কহিলেন, 'যদি টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিয়া আনিতে না পার, তবে তোমার গর্দান কাটিয়া ফেলিব!'
গর্দান কাটার ভয়ে প্রধান সেনাপতি বনের মধ্যে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন!
বনের মধ্যে ছিল এক কাঠুরিয়া।
সে-ই প্রধান সেনাপতিকে পরামর্শ দিল, 'বলি, সেনাপতি মহাশয়।
কামান বন্দুক দিয়া টুনটুনি আর টুনটুনাকে ধরিতে পারিবেন না।
জেলেকে ডাকিয়া বনের মধ্যে জাল ফেলিতে বলুন।
সেই জালে টুনটুনি পাখি ধরা পড়িবে।'
কাঠুরিয়ার কথা শুনিয়া প্রধান সেনাপতি জেলেকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সোয়ালক্ষ নাতিপুতি লইয়া জেলে আসিয়া সমস্ত বন জুড়িয়া জাল পাতিল। সেই জালে টুনটুনি আর
টুনটুনা ধরা পড়িল।
টুনটুনি আর টুনটুনাকে হাতে পাইয়া রাজা ঘরে চলিলেন।
রাজার একশ এক রানী।
পিলে রানী, জ্বরো রানী, কেশো রানী, বেতো রানী, মোটা রানী, পাতলা রানী, কোঁড়া রানী, তোতলা রানী, কানা রানী, বোবা রানী, আলসে রানী, চটপটে রানী, দুষ্টু রানী,
মিষ্টি রানী, কত রানীর নাম আর করিব?
সব রানীরা আসিয়া রাজাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।
কেহ খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আসিল, কেহ জ্বরে কাঁপিতে কাঁপিতে আসিল, কেহ আলসি ভাঙিতে ভাঙিতে ভাসিল, কেহ চটপট করিয়া আসিল, কেহ ঘুমে ঢুলিতে ঢুলিতে
আসিল, সবাই আসিয়া রাজাকে ধরিল,
'মহারাজ আজ শিকারে যাইয়া কি আনিলেন?'
রাজা বলিলেন, 'আজ শিকারে যাইয়া টুনটুনি আর টুনটুনা পাখি ধরিয়া আনিয়াছি।'
তখন পিলে রানী পিলের ভরে কোঁকাইতে কোঁকাইতে বলিলেন, 'দেখি ত কেমন টুনটুনি পাখি?'
রাজা পিলে রানীর হাতে পাখি দুটি দিয়া রাজসভায় যাইয়া এই রাজদ্রোহী পাখি দুটির বিচারের বন্দোবস্ত করিতে মনোযোগ দিলেন।
এদিকে পিলে রানীর হাত হইতে টুনটুনি পাখি গেল জ্বরো রানীর হাতে, তার হাত হইতে গেল কেশো রানীর হাতে, তারপর এর হাতে ওর হাতে নানা হাতে ঘুরিতে ঘুরিতে
টুনটুনি পাখি যখন আলসে রানীর হাতে আসিল, অমনি টুনটুনি করিল ফুরুৎ ফুরুৎ, টুনটুনা করিল সুরুৎ সুরুৎ!
দুইজন দুইদিকে পালাইল।
রাজার একশ এক রানী ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।
পরদিন রাজা রাজসভায় বসিয়া আছেন; কাশী, কাঞ্চি, কনোজ নানান দেশ হইতে পণ্ডিতেরা আসিয়াছেন রাজদ্রোহী টুনটুনি আর টুনটুনা পাখির বিচার করিতে।
রাজসভায় পাখিদের ডাক পড়িল।
শামুকের কৌটা হইতে নস্য নাকে পুরিয়া, বড় বড় কেতাব উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পণ্ডিতেরা রাজদ্রোহী পাখির কি শাস্তি হইতে পারে তাই বাহির করিতে ব্যস্ত; কিন্তু টুনটুনা
আর টুনটুনি পাখি আসে না।
রাজা রাগিয়া মাগিয়া রাজসভা ছাড়িয়া রানীদের মধ্যে যাইয়া উপস্থিত। 'কোথায় সেই রাজদ্রোহী পাখি?'
তখন এ রানী চায় ও রানীর মুখের দিকে, ও রানী চায় সে রানীর মুখের দিকে।
রাজার মাথার উপর তখন টুনটুনি পাখি উড়িয়া চলিয়াছে ফুরুৎ ফুরুৎ।
রাজা সবই বুঝিতে পারিলেন।
রাগিয়া মাগিয়া রাজা তখন একশ এক রানীর নাক কাটিয়া ফেলিলেন।
টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রাজার মাথার উপর দিয়া ফুরুৎ ফুরুৎ ওড়ে, আর গান গায়-
'আমি টুনা টুন-টুনাইলাম,
একশ রানীর নাক কাটাইলাম।'
কি, এত বড় বুকের পাটা টুনটুনি পাখির!
রাজার কুলের কথা লইয়া ছড়া কাটে!
ধর টুনটুনি পাখিকে।
জেলে আবার তার সোয়ালক্ষ নাতিপুতি লইয়া রাজবাড়িতে হাজির; পাখি দুটি জালে ধরা পড়িল।
রাজা তাহাদের হাতে পাইয়া কলাপাতার মতো কাঁপিতে লাগিলেন।
এবার আর বিচার-আচারের প্রয়োজন নাই।
এক গ্লাস পানি লইয়া রাজা পাখি দুটিকে গিলিয়া খাইয়া ফেলিলেন।
তখন রাজসভায় বড় বড় পণ্ডিত বড় বড় কেতাব দেখিয়া মাথা নাড়িলেন। তাহাদের মাথানাড়া দেখিয়া মন্ত্রী মহাশয় ভাবিত হইলেন।
পণ্ডিতেরা মন্ত্রী মহাশয়কে সাবধান করিয়া দিলেন,
'মহারাজ যদি কোনো মূহুর্তে হাসিয়া উঠেন, তবে পাখি দুটি রাজার হাসিমুখের ফাঁক দিয়া বাহির হইয়া আসিবে।'
মন্ত্রী মহাশয় সেয়ান লোক।
তিনি খাড়া তলোয়ার হাতে দুই সেপাইকে রাজার দুই পাশে দাঁড় করাইয়া দিলেন।
যদিবা রাজা মহাশয় হাসিয়া ফেলেন, আর সেই ফাঁকে টুনটুনি পাখিরা বাহির হইয়া আসিতে চায়; তখনি তারা তলোয়ার দিয়া মারিবে কোপ, রাজার দুই পাশ হইতে দুই
টুনটুনি পাখির ঘাড়ে।
খোকাখুকুরা, তোমরা কেহ হাসিও না যেন!
কেউ হাসিও না।
একি হাসিয়া দিলে যে?
তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রাজা মহাশয়ও যে হাসিয়া উঠিলেন!
সেই হাসির ফাঁকে টুনটুনি আর টুনটুনা ফুরুৎ করিয়া উড়িয়া পালাইল।
রাজার দুই ধার হইতে দুই সেপাই তলোয়ার উঠাইয়া মারিল কোপ।
টুনটুনির গায় ত লাগিল না।
লাগিল রাজা মহাশয়ের নাকে।
নাক কাটিয়া দুইখান।
টুনটুনি আর টুনটুনা তখন রাজা মহাশয়ের মাথার উপর দিয়া উড়িয়া বেড়ায়, আর গান গায়-
'আমি- টুনটুনা টুন-টুনাইলাম
রাজা মশাইর নাক কাটাইলাম
- নাক কাটাইলাম।'