সাগর পাড়ের গ্রাম।
সেই গ্রামে ছিলেন এক জমিদার।
জমিদারের প্রচুর ধনসম্পদ।
একদিন সাগরে ঝড় উঠলো।
সে কী তুমুুল ঝড়!
সাগরে ভাসা নৌকাগুলো উল্টে যেতে লাগলো।
গাছপালা ভাঙতে লাগলো।
তারপর অনেক বড় এক ঢেউ এসে পুরো গ্রাম ভাসিয়ে দিলো।
গ্রামের ঘরবাড়িসহ অনেক মানুষ ভেসে গেলো।
এদের মধ্যে মারা পড়লো অনেকে।
জমিদারও গভীর সাগরে ভেসে গেলেন।
অনেকে আবার এদিক ওদিক ভেসে গেলো।
স্বামীকে বাঁচাতে না পারলেও জমিদারের বউ দুই ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
একটি ভেলায় দুই ছেলে আর নিজেকে বেঁধে নিলেন।
তারপর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে অন্য এক গ্রামে পৌঁছে গেলেন।
এরপর মা ও দুই ছেলে সেখানে বসবাস শুরু করেন।
বড় ভাই গ্রামের পাশের নদীতে মাছ ধরে।
ছোট ভাই গ্রাম পাহারা দেয়।
দুই ভাই বড় হলে মা তাদের বিয়ে করান।
একদিন বড় বউ তার স্বামীকে বললো-
‘তুমি কেমন মানুষ?
সারাদিন খাটাখাটুনি করো।
ওদিকে ছোট ভাই রাতে গ্রাম পাহারা দেয়।
দিনের বেলায় ঘুমায় আর পায়ের উপর পা তুলে নাচায়।
চলো আমরা আলাদা হয়ে যাই।’
এ কথা শুনে মা মনে খুব কষ্ট পেলেন।
কিন্তু কিছুই বললেন না।
এ কথা শুনে ছোট বউ খুব রাগ করলো।
কিন্তু কিছুই বললো না।
এ কথা শুনে ছোট ভাই অভিমান করলো।
কিন্তু কিছুই বললো না।
সত্যি সত্যি একদিন তারা ভাগ হয়ে গেলো।
ছোট ছেলে তার মা ও বউকে নিয়ে অন্য এক গ্রামে চলে গেলো।
শাশুড়িকে খুব মানতো ছোট বউ।
শাশুড়ির যাতে কোনো কষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখতো।
হাটে-বাজারে মুটের কাজ করে ছোট ছেলে।
কাজ করে সামান্য যা পায় তা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
একদিন মায়ের খুব ইচ্ছে হলো বড় কোরাল মাছ খাওয়ার।
সেই কবে তারা যখন জমিদার ছিল, তখন খেয়েছিল।
এরপর আর কোরাল মাছ খাওয়া হয়নি।
কী করবে ভেবে পায় না ছোট ছেলে।
বউয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে।
ছোট বউ বললো-
‘আমরা না হয় দু’বেলা কম খাবো।
ওনার জন্য কোরাল মাছ আনার চেষ্টা করো।’
ছেলে গেলো নদীর পাড়ে।
কোরাল মাছ কেনার পয়সা নেই।
বাজার থেকে একটু দূরে গাছের নিচে বসে আছে।
এক লোক তাকে দেখে ভাবলো এই যুবকটি এখানে একা বসে আছে কেন? ওকে অনেক বড় ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে।
লোকটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।
এসে জিজ্ঞেস করলো-
‘এখানে একা একা বসে কী চিন্তা করছো?’
‘আমার মা কোরাল মাছ খেতে চেয়েছেন।
আমি গরিব মানুষ।
পয়সা কড়ি নেই।
কোরাল মাছ আমি কোথায় পাবো?’
ছেলেটির কথা শুনে লোকটির দয়া হলো।
সে বাজারের সবচেয়ে বড় কোরাল মাছটি কিনে দিলো।
সঙ্গে কিনে দিলো মাছ রান্নার নানা মসলাপাতিও।
লোকটি বললো-
‘পৃথিবীতে মায়ের উপর কেউ নেই।
তাকে মাছ রান্না করে খাওয়াও।
মায়ের মন খুশি হলে তুমি অনেক বড় হবে।’
এই কথা বলে লোকটি চলে গেলো।
ছেলেটি কোরাল মাছ নিয়ে বাড়িতে এলো।
এতো বড় কোরাল মাছ দেখে বউয়ের চোখ ছানাবড়া।
মায়ের চোখ ছলছল।
কতোদিন পর এতো বড় মাছ এসেছে ঘরে!
মাছ কুটতে বসেছে ছোট বউ।
মা টুকটাক এটা সেটা ধোয়া-মোছা করছেন।
মাছের পেট কাটতে গিয়ে চমকে উঠলো ছোট বউ।
আগুনের মতো কী যেন ঝিকিমিকি করছে মাছের পেটে!
ছোট বউ খুব সাবধানে মাছের পেট থেকে আগুন রঙা থলিটা বের করলো। সে বুঝতে পারলো, এটা নিশ্চয়ই সেই মানিক হবে।
যে মানিকটির কথা সে একদিন তার মায়ের কাছে শুনেছিল।
মা বলেছিলেন-
‘একটা মানিক সাত রাজার ধন। যে পায় সে অমূল্য রতন...।’
ছোট বউ প্রথমে মানিকটি লুকিয়ে রাখলো অন্য একটি হাঁড়িতে।
রাতে ঘুমাতে গেলে সে স্বামীকে সব খুলে বললো।
সব শুনে ছেলেটির মনে পড়লো বাজারের সেই লোকটির কথা।
যে তাকে কোরাল দিয়েছিল।
বলেছিল-‘পৃথিবীতে মায়ের উপর কেউ নেই।
মায়ের মন খুশি হলে তুমি অনেক বড় হবে।’
ছেলেটির অনেক ধনসম্পদ হলো।
তা দিয়ে সে এক জমিদারি কিনে ফেললো।
বড় জমিদার হয়ে উঠলো সে।
আর দূরদেশে বড় ভাই পড়লো বিরাট বিপদে।
একদিন নদীতে ডাকাত এসে তার মাছ ও জাল সব নিয়ে গেলো।
সব হারিয়ে গরিব হয়ে গেলো বড় ভাই।
নানাজনের কাছ থেকে ছোট ভাইয়ের কথা জানতে পারলো সে।
ছোট ভাই এখন অনেক বড় জমিদার।
এ কথা জানতে পেরে বড় ভাই রওনা দিল ছোট ভাইয়ের খোঁজে।
একদিন ঠিকই পেয়ে গেলো তাকে।
বড় ভাইকে পেয়ে ছোট ভাইয়ের খুশি যেন আর ধরে না।
সব কথা শুনে ছোট ভাই বড় ভাইকে বললো-
‘আজ থেকে তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।’
আর মায়ের কথা কী বলবো!
আগে ছিল জমিদার বউ।
এখন তিনি জমিদারের মা।