'লেটারস ফ্রম অ্যা ফাদার টু হিজ ডটার' বাংলায় 'মা-মণিকে বাবা' নামে বই থেকে সেই বিখ্যাত বাবার এই চিঠি পড়ে দেখো। কেমন লাগে। চিঠির অনুবাদক হেনা চৌধুরী। চিঠি পড়ো আর বোঝো, প্রতিটি বাবা-মা কী প্রগাঢ় ভালোবাসেন ছেলেমেয়েদের।
এ কথা তুমি জানো নিশ্চয়ই মামণি, আমাদের পৃথিবীটা সূর্যের চারদিকে ঘোরে আর চাঁদের পথপরিক্রমাও আমাদের এই পৃথিবীকেই ঘিরে। তুমি এ কথাও জানো হয়তো যে, আমাদের পৃথিবীর মতো আরও অনেক জিনিস সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এদের এবং আমাদের পৃথিবীকে বলা হয় সূর্যের গ্রহ।
চাঁদের অস্তিত্ব আমাদের পৃথিবীকে অবলম্বন করে, সে জন্য চাঁদকে এই পৃথিবীর উপগ্রহ বলা হয়। অন্যান্য গ্রহমণ্ডলীরও এই রকম উপগ্রহ আছে। সূর্য এবং গ্রহমণ্ডলী, তাদের উপগ্রহগুলো নিয়ে সৃষ্টি করেছে যেন এক পরম সুখী পরিবারের।
একে সৌরমণ্ডল নামে অভিহিত করা হয়। সৌর মানে কী জানো তো? সৌর কথার অর্থ সূর্য, আর সূর্য সমগ্র গ্রহমণ্ডলীর জনক বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে সৌরমণ্ডল।
রাত্রিবেলা তুমি দেখতে পাও আকাশের বুকে ঝকমকিয়ে ওঠে হাজার হাজার তারকারাজি। তার মধ্যে গ্রহের সংখ্যা খুবই কম। আবার তাদের প্রকৃতপক্ষে তারকা নামেও অভিহিত করা যায় না।
আচ্ছা মামণি! তুমি কি গ্রহ ও তারার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারো? গ্রহরা আমাদের পৃথিবীর মতোই আকারে ছোট, বিশেষ করে তারকাদের তুলনায়। তাহলে তা এত বড় দেখায় কেন? এর কারণ, গ্রহরা পৃথিবীর খুব কাছের প্রতিবেশী।
চাঁদের বেলায়ও সেই একই কারণ। পৃথিবীর অত্যন্ত কাছের প্রতিবেশী বলে চাঁদকেও আমরা এত পরিস্কার ও বড় দেখি।
তবে গ্রহ ও তারকার সত্যিকারের পার্থক্য নির্ণয় করতে গেলে তাদের জ্বলজ্বল করা দেখে বুঝতে হবে। অর্থাৎ নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে, গ্রহ করে না। গ্রহদের যেটুকু উজ্জ্বলতা আমরা দেখতে পাই তার কারণ, সূর্যের আলো গিয়ে পড়ে তাদের ওপর, আর সেই আলোই উজ্জ্বল করে তোলে তাদের।
চাঁদের আলো বলে যাকে আমরা জানি, সেটাও কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সূর্যেরই জ্যোতি, চাঁদের গায়ে প্রতিভাত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে। প্রকৃত তারকারা সূর্যেরই মতোন উত্তপ্ত আর জ্বলন্ত বলে আপন আলোয় আলোকিত।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের সূর্যও একটি তারকা। তবে তারকাদের তুলনায় পৃথিবীর অপেক্ষাকৃত কাছে থাকার জন্য তাকে অপূর্ব এক জ্বলন্ত আগুনের বলের মতো দেখায়।
সুতরাং এবার তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের এই পৃথিবীও সূর্যের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সৌরমণ্ডলেরই অন্তর্গত। আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমাদের নিজেদের সঙ্গে তুলনা করলে এই পৃথিবীকে কি বিরাট আকৃতির বলেই না মনে হয়!
অতি দ্রুতগতির ট্রেন বা স্টিমারে করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে সময় লাগে কত জানো? সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। কিন্তু আমাদের যা এত অসীম বলে মনে হয়, আসলে কিন্তু তা সামান্য ধূলিকণার মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো একটি পদার্থমাত্র।
সূর্যের অবস্থান যার কাছ থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে। আর তারারা আরও অনেক অনেক দূরের।
নক্ষত্র-বিশারদরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যেরই একটি অংশ মাত্র ছিল। আর সূর্য তখন ছিল ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত জ্বলন্ত একটি অগ্নিপিণ্ড মাত্র। তারপর যেভাবেই হোক, সূর্যের থেকে এর কিছু অংশ বিচ্যুত হয়ে গিয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ল বায়ুতে।
কিন্তু পিতা সূর্যকে ছেড়ে যেতে তারা পারল না। তাই ঠিক যেন একই সুতায় গাঁথা মালার পুঁতির মতো সেই অংশগুলো আবদ্ধ হয়ে রইল। শুরু হলো তাদের সূর্যকে ঘিরে পথপরিক্রমা।
আশ্চর্য এ প্রকৃতির আকর্ষণ শক্তি! যাকে আমি একই সুতায় গাঁথা মালার পুঁতি বন্ধনের সঙ্গে উপমা দিয়েছি। এটা এমনই একটা শক্তি যা সব সময় ক্ষুদ্রকে বৃহতের প্রতি আকর্ষণ করে। এ আকর্ষণীয় শক্তির বলেই যে কোনো বস্তু শূন্যে অবস্থান না করে নিচের দিকে নেমে আসে।
আমাদের কাছাকাছি পৃথিবী হচ্ছে সবচেয়ে বড়। সুতরাং দিন-রাত পৃথিবী আমাদের সব কিছুকে, তার আপন গতি ও শক্তি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। অতএব বুঝতে পারলে তো মামণি!
আমাদের এ পৃথিবী সূর্য থেকে বিচ্যুত একটি অংশমাত্র। এখন পৃথিবীর গল্প শোনো। সৃষ্টির প্রথম অবস্থায়, আমাদের এই পৃথিবীটাও ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত বাষ্পে পরিপূর্ণ। কিন্তু বিশাল সূর্যের তুলনায় তো আকৃতিতে তা অনেক ছোট!
তাই একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করল। তারপর ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত বিরাট সূর্যের তাপও আস্তে আস্তে কমে এলো। কিন্তু তাই বলে তা দু’চার হাজার বছরে সম্ভব হয়নি, লেগেছিল লাখ লাখ বছর।
সেই তুলনায় ঠাণ্ডা হতে আমাদের পৃথিবীর নিশ্চয় অনেক কম সময়ই লেগেছিল। যখন আজকের এই পৃথিবীটা ছিল শুধু জ্বলন্ত এক অগ্নিপিণ্ড সেদিন এর বুকে না মানুষ, না পশুপাখি, না গাছপালা; কোনো কিছুর পক্ষে বাস করা সম্ভব হয়নি।
কেমন করেইবা হবে! সামান্য গ্রীষ্ম কালেই যদি তাপমাত্রা একটু বেড়ে যায়, তো আমাদের অবস্থটা এখানে কী হয় ভেবে দ্যাখো তো? তাহলে কল্পনা করতে পার; সেই জ্বলন্ত অগ্নিবলয় থেকে খসে যাওয়া, সেদিনের এই পৃথিবীরূপী এক টুকরো অঙ্গারের ভয়াবহ উত্তাপের কথা।
সূর্যের একটি কণিকা থেকে যেমন সৃষ্টি হলো আমাদের পৃথিবী তেমনি আবার পৃথিবীর একটি টুকরো থেকে জন্ম নিলো চাঁদ।
একটা খুব মজার কথা, অনেকে মনে করেন কী জানো? আমেরিকা ও জাপানের মধ্যবর্তী স্থলে, যেখানে বর্তমান প্রশান্ত মহাসাগর অবস্থিত, বহুদিন আগে সেখানে ছিল বিরাট এক শূন্যতা। এক গহ্বর। আর সেই গহ্বরের হৃদয় ভেদ করে উদিত হয়েছিল চাঁদ।
যাই হোক, আমাদের পৃথিবীটা তো দিব্যি ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। অবশ্যই তা বহু বছরের সাধনার ফল। আর বাইরেটা যদিওবা আস্তে আস্তে একটু একটু করে ঠাণ্ডা হলো। তবে এর ভেতরের দিকটা প্রচণ্ড উত্তপ্তই রয়ে গেল। তার প্রমাণস্বরূপ আজও যদি তুমি কোনো কয়লার খনির ভেতরে নামো তো অনুভব করবে ভয়ঙ্কর গরম।
আর যতই তুমি গভীরে নামবে ততই দেখবে উত্তাপও ক্রমেই বাড়ছে। এ থেকেই কি কথাটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে ওঠে না যে পৃথিবীর গভীর প্রদেশ আজও জ্বলন্ত ও উত্তপ্ত!
চাঁদ তো আকৃতিতে আমাদের পৃথিবীর চেয়ে অনেক ছোট, তাই পৃথিবীর চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি তা শীতলও হয়ে গেল। বলো মামণি, আজও তো চাঁদকে কী মধুর মনোরম আর শীতল বলে মনে হয়, তাই না?
তাই তো চাঁদের নামকরণ করা হয়েছে শীতল চাঁদ। আমার কি মনে হয় জানো, এর অভ্যন্তর ভাগ বরফ আর হিমবাহে পরিপূর্ণ।
তারপর একদিন পৃথিবী শীতলতা পেল। বায়ুতে আর্দ্রতা অর্থাৎ জলীয় বাষ্প আছে, তা ক্রমেই ঠাণ্ডা গাঢ় হতে হতে জলে পরিণত হলো। আর সম্ভবত তা একদিন বৃষ্টি হয়ে আবার এই পৃথিবীর বুকেই ঝরে পড়ল।
সে বৃষ্টি অবশ্য এখন আমরা যে বৃষ্টি দেখি, নিশ্চয়ই তার চেয়ে লাখ লাখ গুণ সাংঘাতিক রকমের ভয়াবহ বৃষ্টি হয়েছিল। সম্ভবত তাকেই আমরা প্রলয় বলে থাকি। কারণ সেই প্রচণ্ড প্রলয়ঙ্কর বরিধারায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল ধরণীর বুকের সব গহ্বর। জন্ম নিলো সাগর আর মহাসাগররা।
পৃথিবী ঠাণ্ডা হওয়ার পর মহাসমুদ্রের জলও ঠাণ্ডা হতে লাগল আস্তে আস্তে তারপর পৃথিবীর কোলে আর মহাসাগরের জলে প্রাণীর পক্ষে বসবাস করা সম্ভব হয়ে উঠল। পরবর্তী চিঠিতে আমরা প্রাণের সূচনা সম্পর্কে আলোচনা করব।