গাজা উপত্যকায় হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে অন্তত চারটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে সমর্থন ও সহায়তা দিচ্ছে ইসরায়েল। শনিবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। গাজায় সর্বশেষ গঠিত একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা হুসাম আল-আস্তাল স্কাই নিউজে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
আস্তাল জানান, ‘প্রজেক্ট নিউ গাজা’ নামে একটি পরিকল্পনার আওতায় চারটি বিদ্রোহী গ্রুপ একযোগে কাজ করছে। এসব গ্রুপের লক্ষ্য গাজা থেকে হামাসের শাসন অপসারণ। তিনি আরও দাবি করেন, এই উদ্যোগে অন্য নেতাদের মধ্যে ইয়াসের আবু শাবাব ও আশরাফ আল-মানসিও যুক্ত হয়েছেন।
স্কাই নিউজের তথ্যমতে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ)-এর পোস্ট থেকে মাত্র ৭০০ মিটার দূরে গাজা সীমান্তের ইয়েলো লাইন এলাকায় আস্তালের সদরদপ্তর অবস্থিত। আইডিএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ে একটি ‘গ্রিন জোন’ চুক্তি হয়েছে। গ্রিন জোন এলাকায় কোনো গোলাগুলি বা বিমান হামলা চালানো হবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে আইডিএফ।
প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আস্তালের ব্যবহৃত কিছু গাড়িতে হিব্রু লেখা ছিল যা পরে মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব যানবাহন গাজার বাইরে থেকে আনা হয়েছে এবং তারা কালোবাজার থেকে হামাসের কিছু অস্ত্রও কিনেছে।
স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবু শাবাব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর এক সদস্য দাবি করেছেন, ইসরায়েল তাদের অস্ত্র, নগদ অর্থ ও যানবাহন গোপনে গাজায় আনতে সহায়তা করেছে। অন্য দুটি গোষ্ঠীও নাকি একই ধরনের সহায়তা পেয়েছে।
তবে আল-মানসি সংগঠনের নেতারা আইডিএফের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কথা অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তারা শুধু জেলা অফিসের মাধ্যমে সমন্বয় করে থাকে যা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হয়।
গাজায় নতুন বেসামরিক প্রধান নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও টেকসইভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এক অভিজ্ঞ কূটনীতিককে নতুন বেসামরিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেসামরিক প্রধান হিসেবে স্টিভ ফ্যাগিন এই দায়িত্ব পালন করবেন।
ফ্যাগিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্যাট্রিক ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে কাজ করবেন। প্যাট্রিক ইতোমধ্যেই ‘সিভিল-মিলিটারি কোঅর্ডিনেশন সেন্টারের’ সামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্বে আছেন। অক্টোবরের ১০ তারিখে যুদ্ধবিরতির হওয়ার পর ১৭ অক্টোবর ইসরায়েলে এই কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রটির কাজ হলো যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণ এবং গাজায় ত্রাণ সরবরাহসহ অন্যান্য লজিস্টিক কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
জানা গেছে, প্রায় ২০০ মার্কিন সেনা বর্তমানে কেন্দ্রটিতে কাজ করছেন। সেখানে ইসরায়েল, ইউরোপীয় দেশগুলো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একযোগে কাজ করছেন মার্কিন সেনারা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত শুক্রবার কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি এ পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় উত্থান-পতন থাকবে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি নিয়ে আমাদের যথেষ্ট আশাবাদী।
স্টিভ ফ্যাগিন দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি ফ্যাগিন একই সঙ্গে ইয়েমেনের রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি ইরাকের বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক হিসেবেও তিন মাস দায়িত্ব পালন করেছেন।
নিরপেক্ষ প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা দিতে একমত হামাস-ফাতাহ
যুদ্ধবিরতির পর গাজার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কমিটি গঠনে সম্মত হয়েছে ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। নিরপেক্ষ এ প্রশাসনের হাতে গাজা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে হামাস, ফাতাহসহ অন্যান্য মুক্তিকামী সংগঠন।
গত শুক্রবার কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে হামাসের ওয়েবসাইটে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকা পরিচালনার দায়িত্ব একটি অস্থায়ী নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ প্রশাসনিক কমিটি আরব দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় গাজায় মৌলিক সেবা পরিচালনা করবে।
এছাড়া যৌথ বিবৃতিতে জাতীয় লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল দলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। দলগুলো ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে তার ভূমিকা শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিম তীরের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে পিএলও- ফাতাহ। এ সংগঠনের সঙ্গে আদর্শ ছাড়াও রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে হামাসের। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কায়রোতে হামাস ও ফাতাহ প্রতিনিধিদলের মধ্যে মার্কিন সমর্থিত গাজা যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ ভবিষ্যতেও বৈঠক চালিয়ে যাওয়ার এবং ইসরায়েলি সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ফিলিস্তিনি অভ্যন্তরীণ ঐক্য জোরদার করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
এই বিষয়ে হামাসের মিত্র ইসলামিক জিহাদসহ পিএলও-ভুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ফিলিস্তিনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন মিসরের গোয়েন্দা প্রধান হাসান রাশাদ।
২০০৬ সালের নির্বাচনের পর হামাস ও ফাতাহর রাজনৈতিক বিরোধ একসময় সংঘর্ষে রূপ নেয়। এ সংঘর্ষ দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি ঐক্যের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে উভয় দল যুদ্ধ পরবর্তী গাজা প্রশাসনের জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠনে সম্মত হয়েছে।
২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হামাস আগেই জানিয়েছে যে, তারা যুদ্ধোত্তর গাজার প্রশাসন চালাতে আগ্রহী নয়। তবে সংগঠনের যোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার বিরোধিতা করছে হামাস।