যুদ্ধবিরতি শুরুর পর ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলিদের নির্বিচার হামলায় এখন পর্যন্ত ৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ২৩০ জন। হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর এ তথ্য জানিয়েছে। গাজার গণমাধ্যম দপ্তর আরও বলেছে, ইসরায়েলিরা এখন পর্যন্ত ৮০ বার যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরায়েলের দাবি, এতে ১ হাজার ১০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় আড়াইশ মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নেওয়া হয়।
জবাবে ওই দিনই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। দুই বছরের হামলায় গাজায় নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা ৬৮ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
সম্প্রতি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা মেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকরও হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির আওতায় ইসরায়েলি বাহিনীর গাজায় অভিযান বন্ধ করার কথা। বিনিময়ে গাজায় জিম্মি থাকা ব্যক্তিদের (জীবিত ও মৃত) ছেড়ে দেবে হামাস। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের আওতায় জটিল এ প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা হামাস বাহিনীর বিরুদ্ধে চালানো হামলার জবাবে অঞ্চলটির দক্ষিণে বিমান হামলা শুরু করেছে। তবে হামাস দাবি করেছে, তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে। একজন কর্মকর্তা ইসরায়েলকে তাদের নিজস্ব আক্রমণ পুনরায় শুরু করার জন্য ‘অজুহাত’ তৈরি করার অভিযোগ করেছেন।
হামাসকে ‘যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের’ অভিযোগ এনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘গাজা উপত্যকায় ‘সন্ত্রাসী স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার’ নির্দেশ দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতি ১০ অক্টোবর কার্যকর হয়। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধবিরতি বন্ধ করে দেয়। এই চুক্তিতে জিম্মি ও বন্দি বিনিময়ের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল এবং গাজার ভবিষ্যতের জন্য একটি উচ্ছাকাঙ্ক্ষী রোডম্যাপের পাশাপাশি প্রস্তাবিত হয়েছিল; কিন্ত তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আজকের (সোমবার) প্রথম দিকে সন্ত্রাসীরা চুক্তির শর্তাবলি অনুসারে রাফাহ এলাকায় সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংস করতে পরিচালিত আইডিএফ (সেনা) বাহিনীর ওপর ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং গুলি চালায়’।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আইডিএফ রাফাহ এলাকা লক্ষ্য করে যুদ্ধবিমান এবং কামানের গোলাবর্ষণের মাধ্যমে বিমান হামলার জবাব দিয়েছে’।
এর আগে, একজন ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে সৈন্যদের ওপর ‘একাধিক আক্রমণ’ চালিয়েছে।
ফিলিস্তিনি এক প্রত্যক্ষদর্শীরা এএফপিকে জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ইসরায়েল এখনো এই অঞ্চলটি দখল করে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩৮ বছর বয়সি এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, হামাস স্থানীয় ফিলিস্তিনি দল আবু শাবাবের সাথে লড়াই করছিল; কিন্ত হামাস যোদ্ধরা ‘সেনা ট্যাংকের উপস্থিতি দেখে অবাক’।
তিনি বলেছেন, ‘বিমান বাহিনী আকাশ থেকে দুটি হামলা চালায়।’
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করছিলেন, তখন সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর কিছু মন্ত্রী ইসরায়েলি বাহিনীকে ফিলিস্তিনি হামাসের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানান।
এর আগে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী এবং ডানপন্থি ফায়ারব্র্যান্ড ইতামার বেন গভির সেনাবাহিনীকে ‘সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইসরায়েলি উপত্যকায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার’ আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেছেন, ‘হামাস অনুতপ্ত হবে এমনকি তারা যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তা মেনে চলবে।
তিনি বলেছেন, ‘হামাস আমাদের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক’। হামাসকে ‘সম্পূর্ণরূপে নির্মূল’ করার আহ্বান জানান।
হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জত আল-রিশকের এক বিবৃতিতে বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ইসরায়েল ‘চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে এবং তাদের অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তুচ্ছ অজুহাত তৈরি করছে।’
হামাসের সশস্ত্র শাখা গত রোববার জোর দিয়ে বলেছে, তারা ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলছে এবং রাফায় কোনো সংঘর্ষের ‘কোনা ঘটনা ঘটেনি’।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে মার্কিন শান্তি দূত স্টিভ উইটকফ আগামী সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের ২০-দফা পরিকল্পনার অধীনে ইসরায়েলি বাহিনী তথাকথিত হলুদ রেখা অতিক্রম করে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। যার ফলে গাজার প্রায় অর্ধেক অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে অঞ্চলের সীমানা কিন্ত এর প্রধান শহরগুলো নয়।
হামাস ২০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে এবং নিহতদের অবশিষ্ট মরদেহ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
৭ অক্টোবর, ২০২৩ সালে ইসরায়েলের ওপর হামাসের আক্রমণের ফলে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে গাজায় কমপক্ষে ৬৮,১৫৯ জন নিহত হয়েছে।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, জাতিসংঘ মনে করে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে মৃতদের অর্ধেকেরও বেশি নারী এবং শিশু।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৩৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এএফপির হিসাব অনুসারে, ২০২৩ সালে ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলায় ১,২২১ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক।
ইসরায়েল গত রোববার ১৫ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ গাজায় ফিরিয়ে দিয়েছে। ফলে হামাস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মোট হস্তান্তরের সংখ্যা ১৫০ জনে দাঁড়িয়েছে।
গাজায় এখনো জিম্মি মরদেহের বিষয়টি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েল মূল গেটটি পুনরায় খোলার সাথে যুক্ত করেছে। নিহতদের সকলকে উদ্ধারের জন্য এই অঞ্চলে পাঠানো হবে।
ত্রাণ সংস্থাগুলো খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের প্রবাহ দ্রুততর করার জন্য মিসর থেকে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খোলার আহ্বান জানিয়েছে।
হামাস এখন পর্যন্ত নিরস্ত্রীকরণ প্রতিরোধ করেছে এবং যুদ্ধ বিরতির পর থেকে গাজার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
দলটি বলেছে, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অবশিষ্ট মৃরদেহগুলো উদ্ধারের জন্য তাদের সময় এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, তিনি ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাফাহ ক্রসিং বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’
এতে বলা হয়েছে, ‘জিম্মি এবং নিহতদের মরদেহ ফিরিয়ে আনা এবং কাঠামো বাস্তবায়নে হামাস কীভাবে তার ভূমিকা পালন করে তার ওপর ভিত্তি করে এটি পুনরায় খোলার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’
গত শনিবার রাতে হামাস সতর্ক করে দিয়েছিল, রাফাহ ক্রসিং বন্ধ করার ফলে ‘অবশেষ উদ্ধার এবং স্থানান্তরে উল্লেখযোগ্য বিলম্ব’ হবে।