ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের কারণে গাজায় ছয় বছরের কম বয়সি প্রায় ৫৫ হাজার শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। পুষ্টিহীনতার কারণে এদের মধ্যে ১২ হাজারের বেশি শিশুর অবস্থা গুরুতর যা দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণ হতে পারে। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক চিকিৎসা জার্নাল দ্য ল্যানসেট- এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
প্রকাশিত এ গবেষণাটি পরিচালনায় সহায়তা করেছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। এ গবেষণায় যুদ্ধ চলাকালে শিশুদের পুষ্টিহীনতার সঙ্গে ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ গবেষণায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত গাজায় ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সি দুই লাখ ২০ হাজার শিশুর বাহুর পরিধি মেপে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শিশুদের ৫ শতাংশে অপুষ্টির লক্ষণ পাওয়া যায়। তবে ছয় মাস পর এ হার বেড়ে ৯ শতাংশ হয়।
২০২৪ সালের শেষ দিকে ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েল কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এ হার দ্বিগুণের বেশি হয়। গবেষণা অনুযায়ী, গাজার মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ৫৪ হাজার ৬০০ শিশুর জরুরি পুষ্টি ও চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন।
ইউএনআরডব্লিউয়ের স্বাস্থ্য পরিচালক ও গবেষক ড. আকিহিরো সেইতা জানিয়েছেন, যুদ্ধ থামিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক মানবিক ত্রাণ, চিকিৎসা ও পুষ্টি সহায়তা না পেলে আরও অনেক শিশুর মৃত্যু হবে।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ১ হাজার ৪০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৫৯ জন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রের কাছে নিহত হয়েছেন। এদের অধিকাংশের মৃত্যু ইসরায়েলি সামরিক হামলায় ঘটেছে।
গাজায় স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে প্রস্তুত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্থায়ী শান্তির পথে বড় পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস। এ যুদ্ধবিরতির ফলে গাজায় স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনে নতুন উদ্যোগে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেন, ডব্লিউএইচও গাজার ভয়াবহ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ বাড়াতে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য খাত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় বসবাস করা প্রতি ১০ জনে একজন নিহত বা আহত হয়েছেন। প্রতি ১০টি বাড়ির মধ্যে নয়টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। কৃষি জমির ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা উজাড় হয়ে গেছে। গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ নিহত বা আহত, এবং হাজার হাজার মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। গাজায় আহত প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মধ্যে ৪০ হাজারেরও বেশি জীবন-পরিবর্তনকারী গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) ‘অপারেশন আয়রন সোর্ড’ পরিচালনা করে গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে যেখানে ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির বসবাস ছিল। মাত্র ৩২০ বর্গ কিলোমিটারের উপত্যকার ওপর ১ লাখ টনের বেশি বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেছে আইডিএফ।
ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতায় গাজায় ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার আহত হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইউনিসেফের তথ্য মতে, এ যুদ্ধে ২০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৪২ হাজারের বেশি শিশু যাদের মধ্যে অন্তত ২১ হাজার শিশু স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
মুক্তি পাবে ২০০০ ফিলিস্তিনি বন্দি
গাজা চুক্তির আওতায় মুক্তি পাবে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তি সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত তথ্য ওঠে আসছে। চুক্তির আওতায় প্রায় ২০ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। এরপর মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষ পর্যায়ক্রমে হস্তান্তর করা হবে। অপরদিকে ইসরায়েল এক হাজার ৯৫০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
এখন এই চুক্তির অন্যান্য অংশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ কীভাবে ঘটবে এবং কখন ঘটবে সে সম্পর্কে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
গাজার একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থেকে সেনা প্রত্যাহ্যারের বিষয়ে সম্মত হয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু হামাসের দাবি, ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং গাজায় যুদ্ধ বন্ধের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজের শন হ্যানিটির সঙ্গে আলাপকালে বলেন, শান্তি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের পর আপনারা দেখতে পাবেন যে লোকজন একসঙ্গে কাজ করছে এবং গাজা পুনর্নির্মাণ করা হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, এটি একটি ‘ভিন্ন বিশ্ব’ হতে চলেছে এবং গাজায় সম্পদ ব্যয় করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, গাজা অনেক নিরাপদ স্থান হতে চলেছে এবং এটি এমন একটি স্থান হতে চলেছে যেখানে পুনর্গঠন হবে এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো এটি পুনর্গঠনে সহায়তা করবে। কারণ তাদের প্রচুর পরিমাণে সম্পদ রয়েছে এবং তারা এটা দেখতে চায়। তিনি আরও বলেন, আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে।