ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় বর্বর হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে এক দিনে কমপক্ষে আরও ৭৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল গাজা সিটিতেই নিহত হয়েছেন ৪৪ জন। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্বিচার বোমা বর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে গাজা সিটির পাড়ামহল্লা। আতঙ্কে পালাতে চাইছেন মানুষ, কিন্তু গোটা উপত্যকাতেই নিরাপদ আশ্রয় নেই। টানা ২৩ মাস ধরে চলছে এ নির্মম হামলা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই গাজা সিটিকে আখ্যা দিয়েছে ‘আতঙ্কের নগরী’ বলে। গত বৃহস্পতিবার তাল আল-হাওয়া এলাকায় একটি তাঁবুতে হামলায় একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হন, যাদের মধ্যে তিনজনই শিশু।
হামলার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত তাঁবুগুলোর সামনে ফিলিস্তিনিরা ভাঙাচোরা মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে রক্তে ভেজা একটি গোলাপি রঙের স্যান্ডেলও মেলে। ইসরা আল-বাসুস এএফপিকে বলেন, ‘আমি ও আমার সন্তানরা তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ বোমা পড়ল, শরীরে টুকরো এসে লাগল, আমার চার সন্তান আতঙ্কে চিৎকার শুরু করল।’
গাজা সিটির জেইতুন, সাবরা, তুফাহ, নাসর ও শুজাইয়া এলাকায় ভয়াবহ বোমা বর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। তুফাহ পাড়ায় অন্তত আটজন নিহত ও বহু আহত হয়েছেন বলে জানান সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল।
শুজাইয়ায় একটি আবাসিক ভবনে বিমান হামলায় দুজন নিহত হয়েছেন। আর জেইতুনে ধ্বংসস্তূপ থেকে আল-ঘাফ পরিবারের তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানান, মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছেন নিরাপত্তার খোঁজে, কিন্তু যেখানে যাচ্ছেন সেখানেও ইসরায়েলি বিমান ও গোলাবর্ষণ তাদের পিছু ছাড়ছে না।
ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার যোগাযোগ কর্মকর্তা টেস ইনগ্রাম সতর্ক করে বলেছেন, প্রায় ১০ লাখ মানুষ আটকা পড়েছেন এই ‘ভয়, পালানো ও জানাজায় ভরা নগরীতে’। শুধু গত বৃহস্পতিবারই গাজা সিটিতে নিহত হয়েছেন ৪৪ জন।
ইসরায়েলি সেনাদের তথ্যানুসারে,তারা এখন গাজা সিটির ৪০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং আগামী দিনগুলোতে অভিযান আরও জোরদার করবে।
আল জাজিরার সানাদ ফ্যাক্ট-চেকিং এজেন্সি স্যাটেলাইট ছবিতে অন্তত ৫২টি ইসরায়েলি সামরিক যান জেইতুন এলাকায় মোতায়েন থাকতে দেখেছে।
গাজা কতটা দখলে, জানাল ইসরায়েলি বাহিনী
বর্তমানে গাজা সিটির প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। একই সঙ্গে হামাসকে পরাজিত করার জন্য অভিযান আরও জোরদার করছে।
গত বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এফি ডেফরিন বলেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং আগামী দিনে তা আরও সম্প্রসারিত হবে।
এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গাজা দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করেন এবং প্রায় ৮০ হাজার রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেন। চলমান অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গিডিওনস চারিয়টস বি’। সেনাদের দাবি, আগের ধাপে গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হামাসকে বন্দি বিনিময়ের চাপে রাখা হয়েছিল।
হামাস নতুন এই অভিযানের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের আলোচনাকে উপেক্ষা করছে। সংগঠনটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও যেকোনো সমঝোতার ‘প্রধান অন্তরায়’ বলে অভিযুক্ত করেছে।
অন্যদিকে, যুদ্ধবিরতি নিয়ে মধ্যস্থতাকারীরা নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। হামাস ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি, ধাপে ধাপে বন্দি মুক্তি, ফিলিস্তিনি বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া এবং গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়ানোর একটি প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। তবে ইসরায়েল এখনো সব বন্দিকে একসঙ্গে মুক্তির দাবি করছে।
এদিকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার আল-সাবরা এলাকায় অন্তত পাঁচজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন। একটি বাড়ি ও বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে হামলায় আরও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ২৩১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৬১ হাজার ৫৮৩ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে ক্ষুধায় বা সহায়তা চাইতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
গাজার দিকে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে সুমুদ ফ্লোটিলা
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা গাজার দিকে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। তাদের লক্ষ্য হলো- ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের অবরোধ ভেঙে সেখানে সাহায্য পৌঁছানো, যেখানে এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।
গত রোববার স্পেনের বার্সেলোনা থেকে জাহাজগুলো যাত্রা শুরু করে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা প্রথমে ফিরে যায়, পরে সোমবার আবার যাত্রা শুরু করে।
ঝড়ের পর মেনোরকায় জাহাজগুলো কিছু মেরামতকাজ সম্পন্ন করে এবং গত বৃহস্পতিবার তিউনিসিয়ার উদ্দেশে আবার যাত্রা শুরু করে।
আগামী কয়েকদিনে তারা তিউনিসিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য অংশগ্রহণকারী নৌযানের সঙ্গে মিলিত হবে।
সুমুদ ফ্লোটিলা একটি আন্তর্জাতিক নাগরিক উদ্যোগ, যার লক্ষ্য গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং ইসরায়েলি নৌঅবরোধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ জানানো।