ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান সম্প্রসারণ এবং ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল সোমবার আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা সর্বসম্মতভাবে এ পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছে। এই পরিকল্পনার আওতায় রিজার্ভ সেনাদের ডাক দেওয়া হবে এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সরাসরি ২৩ লাখ জনসংখ্যার গাজা অঞ্চলে খাদ্য ও জরুরি ত্রাণ সরবরাহ পরিচালনা করবে। এই জনগণ ইসরায়েলের অবরোধের কারণে দীর্ঘদিন ধরে মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, নতুন পরিকল্পনার আওতায় ইসরায়েল গাজা পুরোপুরি দখলে নিতে পারে। এএফপির এক সূত্র বলেছে, পরিকল্পনায় গাজা দখল, সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং বাসিন্দাদের দক্ষিণে স্থানান্তরের বিষয় রয়েছে, যাতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই পরিকল্পনাকেই এগিয়ে নিচ্ছেন, যেখানে গাজার ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের প্রস্তাব রয়েছে।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত থাকবে। এসব সংস্থাকে বাইরের নিরাপত্তা দেবে ইসরায়েলি সেনারা, যাতে ত্রাণ বিতরণ নিরাপদভাবে পরিচালিত হয়।
এর আগে মানবিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল, গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসছে। তবে ইসরায়েল সে দাবি অস্বীকার করে এবং মার্চের ২ তারিখ থেকে ১৬ দিন পর্যন্ত সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ রাখে।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য পূর্ণ দখল এবং ত্রাণ ব্যবস্থার সামরিকীকরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি শুধু মানবিক সংকটকেই বাড়াবে না, বরং যুদ্ধাপরাধের আশঙ্কাও উসকে দিচ্ছে। বর্তমানে গাজার অবস্থা চরম মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধের অভাবে প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছেন সাধারণ মানুষ, যার অধিকাংশই শিশু ও নারী।
কোথায় আশ্রয় নেবে ফিলিস্তিনিরা?
গাজার এমন কোনো স্থান বাকি নেই যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালায়নি। পুরো গাজাকে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে দখলদার বাহিনী। ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন পার করছেন। তাদের আশ্রয় নেওয়ার মতো নিরাপদ কোনো জায়গা নেই। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালাচ্ছে না বা এমন কোনো মানবিক অঞ্চল নেই যেখানে তারা আশ্রয় নিতে পারে। ভয়াবহ দুর্বিষহ জীবন পার করছে ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ এবং শিশুরা।
গাজার বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ইসরায়েলি বাহিনী রাফাহ দখল করার পর গাজার বিভিন্ন এলাকায় লোকজন আটকা পড়েছে। তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানেও যেতে পারছেন না। উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণ গাজায় যাওয়ার স্বাধীনতাও পাচ্ছেন না তারা।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান আরও জোরদার ও বিস্তারের লক্ষ্যে হাজার হাজার রিজার্ভ সৈন্য ডাকতে শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি এবং বন্দিদের ফিরিয়ে আনাই তাদের লক্ষ্য।
ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। প্রায় ৪৭০ দিন ধরে চলা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা বাড়ি-ঘর, প্রিয়জন সবকিছু হারিয়েছেন। তাদের মাথার ওপর আশ্রয় নেওয়ার মতো শেষ অবলম্বনটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বোমা হামলায় চোখের সামনে বাবা-ভাই বা সন্তানের মৃত্যু দেখছেন তারা।
এরই মধ্যে নতুন পরিকল্পনার আওতায়, গাজায় ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের সব ধরনের অবকাঠামো ধ্বংস করার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে সমালোচকরা বলছেন, দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবারও শুরু হওয়া এই অভিযান বন্দিমুক্তির নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজায় অভিযান ফের সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন সফর শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান শুরু হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমানে হামাসের হাতে ৫৯ জন জিম্মি রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৪ জনের জীবিত বলে বিশ্বাস করা হয়। গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে আর কোনো ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পায়নি।
এই সময়ের মধ্যে গাজার বিশাল এলাকা দখলে নিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে আবারও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। একই সঙ্গে গাজায় প্রায় দুই মাস ধরে চলছে মানবিক সহায়তার ওপর কঠোর অবরোধ।
গাজায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় হামাস উৎখাত আর তাদের কবল থেকে জিম্মি উদ্ধারের নামে ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যা চলছেই। প্রতিদিনই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা; দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল। নিরাপদ বলে কোনো স্থান বাকি নেই গাজাবাসীর জন্য। একদিকে আকাশ ও স্থল অভিযান, অন্যদিকে ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ; গাজা যেন সাক্ষাৎ নরক হয়ে উঠেছে তার বাসিন্দাদের জন্য। এরই মধ্যে গাজায় সামরিক অভিযানের মাত্রা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
এদিকে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় গাজায় আরও অন্তত ৪০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার বাহিনী। এতে অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৫২ হাজার ৫৪০ ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া গত ১৮ মার্চ গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ২৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।