যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রাজসিক প্রত্যাবর্তনের অনন্য নজির পড়ে হোয়াইট হাউজের পথে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোট গণনায় উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোটে জিতে ম্যাজিক নম্বর ২৭০ পার করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ৭৮ বছর বয়সি ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেতে হয়। সবশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৭৯টি ইলেক্টোরাল ভোট। আর ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছেন ২২৩টি।
তবে এই প্রতিবেদন দাখিলের সময় (বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ৯টা) পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা হয়নি। এজন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা হওয়ার আগেই ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা দেশজুড়ে বিজয় উদ্যাপন শুরু করেছেন। সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন।
মিডিয়া সাবেক এই প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউস জয়ের নেপথ্যে বেশকিছু কারণ খুঁজে পেয়েছে। তার মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে অর্থনৈতিক ইস্যু।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা সাধারণত অন্য কোনো বিষয়ের চেয়ে অর্থনীতিকেই বেশি আমলে নেয়। এবারের নির্বাচনি প্রচারের সময় বিভিন্ন জনমত জরিপে আমেরিকানদের প্রায় অর্ধেকই বলেছিলেন, চার বছর আগের তুলনায় এখন তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। সুতরাং দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাদের কাকে পছন্দ তা বেশ স্পষ্টই ছিল।
এছাড়াও মোটাদাগে যেসব কারণ ট্রাম্পকে এই বিজয় এনে দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- গাজায় বছর গড়িয়ে চলা যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের জোরালো ও খোলামেলা অবস্থান, নারী ও পুরুষ ভোটারের বিভাজন, ট্রাম্পের প্রতি লাতিনো পুরুষদের সমর্থন, জাতিগত সমর্থন, রিপাবলিকানদের পক্ষে যুব ভোটারদের ঝুঁকে পড়া, গ্রামীণ এলাকায় ট্রাম্পের সমর্থন পুনরুদ্ধার, মধ্যপন্থি ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রভাব এবং নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ট্রাম্পের সফলতা।
বিশেষ করে ফল নির্ধারণী সুইং স্টেটগুলোর জয়ই হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফেরার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখে। জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনের মতো ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের জয় দেখিয়ে দেয়- অনেক আমেরিকান ভোটার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সীমান্ত নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্যে এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কমলা হ্যারিস সেই সমর্থন ধরে রাখতে পারেননি।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের তীব্র লড়াই আর ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা শেষ পর্যন্ত ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে আস্থাশীল ট্রাম্পকেই বেছে নিলেন।
২০১৬ সালের প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ এর নির্বাচনে পরাজিত হন। এরপর এবারের নির্বাচনে আবার জয় পেয়েছেন তিনি। বিরল এ জয়ের মাধ্যমে দেশটিতে নতুন ইতিহাস গড়ে হোয়াইট হাউস ছাড়ার চার বছর পর আবার হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হতে চলেছেন ট্রাম্প। এটি তার দারুণভাবে এক রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের নতুন ইতিহাস হতে চলেছে।
এমন প্রত্যাবর্তনের গল্প ট্রাম্পের আগে মাত্র একজন প্রেসিডেন্টই লিখিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট বলছে, ট্রাম্পের আগে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এমন নজির গড়েছিলেন। নির্বাচনে হেরে আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ওই ডেমোক্রেট।
১৮৯৩ সালে তিনি এই ইতিহাস গড়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হন ক্লিভল্যান্ড। দেশটির ২২ ও ২৪তম প্রেসিডেন্ট তিনি। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই রেকর্ড গড়লেন ট্রাম্প।
শুধু তা–ই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প ৬০ বছর বয়সি কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন। এর আগে ২০১৬ সালে তিনি আরেক নারী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এদিকে ট্রাম্পের জয়ের খবরে বিভিন্ন রাজ্যে উৎসবে মেতেছেন তার সমর্থকরা। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারের প্রধান কার্যালয় থেকে বিবিসি জানিয়েছে, ফক্স নিউজ যখন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের অনুমান ঘোষণা করছিল তখন হলরুমে উপস্থিত সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন।
ট্রাম্প স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, ‘আমেরিকার জনগণের জন্য এটি চমৎকার জয়। এটা আমাদের আমেরিকাকে আবারও মহান করার সুযোগ দেবে।’
এটি আমেরিকার স্বর্ণযুগ হবে বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। এ সময় মঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং তার রানিং মেট জে ডি ভান্স।
শপথ ২০ জানুয়ারি
এদিকে ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার খবর সামনে আসতেই জল্পনা শুরু হয়েছে তার শপথ নিয়ে। তিনি কবে শপথ নেবেন তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল ভবনে আগামী ২০ জানুয়ারি তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
১৮৪৫ সাল থেকেই এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে। সে সময় থেকেই নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং জানুয়ারির ২০ তারিখে প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পরিকল্পনা, নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং আইনি ও পদ্ধতিগত সুরক্ষাসহ বেশ কয়েকটি কারণে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং শপথ গ্রহণের মধ্যে কিছুটা সময়ের ব্যবধান রাখা হয়। নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য এই সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধই কাল হলো ডেমোক্রেটদের
ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে, আরব আমেরিকানদের সমর্থনও পেয়েছেন ট্রাম্প। মিশিগানের ডিয়ারবর্নে ভোটাররা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে। এটি এই রাজ্যের সবচেয়ে বড় মুসলিম শহর হিসেবে পরিচিত। আর একে বাইডেন প্রশাসনের ইসরায়েল-গাজার যুদ্ধ নিয়ে নেয়া পদক্ষেপের প্রতি স্পষ্ট প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হামাস তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন সম্পর্কে আমাদের অবস্থান নির্ভর করবে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের আচরণ, তাদের ন্যায়সংগত অধিকার ও আমাদের ন্যায়সংগত ইস্যুর প্রতি তাদের অবস্থানের ওপর।’
হামাস আরও বলেছে, ‘নতুন প্রেসিডেন্টকে গাজার ওপর হামলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মতামত শুনতে হবে। নতুন প্রশাসনের বোঝা উচিত, আমাদের জনগণ দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অধিকার খর্ব করা কোনো পথ তারা মেনে নেবে না।’
এ ছাড়া হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য কাসেম নাইম বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন বন্ধ করা উচিত। কারণ এটি আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ এবং অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।’
নারী ও পুরুষ ভোটারের বিভাজন
২০২৪ সালে নারীদের মধ্যে হ্যারিসের সমর্থন থাকলেও তা ২০১৬ বা ২০২০ সালের তুলনায় বেশি ছিল না। বিশেষত, ট্রাম্প পুরুষদের মধ্যে সমর্থন বজায় রেখেছিলেন।
ট্রাম্পের প্রতি লাতিনো পুরুষদের সমর্থন
২০১৬ সাল থেকে লাতিনো ভোটারদের, বিশেষত পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে বাইডেন এদের বেশির ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালে তারা ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন। তবে লাতিন নারীরা এখনও হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। যদিও তা আগের তুলনায় কম।
জাতিগত সমর্থন
২০২৪ সালে হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও নারীদের মধ্যে শক্তিশালী নেতৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তবে, শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্পের আগের মতো নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল না। শ্বেতাঙ্গ কলেজ-শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে হ্যারিসের সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে কলেজ-শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ নারীদের মধ্যে তিনি প্রায় ২০ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন। যা বাইডেন বা ক্লিনটনের তুলনায় ভালো।
ট্রাম্পের পক্ষে যুব ভোটারদের ঝুঁকে পড়া
২০২৪ সালে ডেমোক্রেটদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভোটার গ্রুপ, অর্থাৎ যুব ভোটারদের কিছুটা সমর্থন কমেছে। যা ডেমোক্রেটদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ায়। তবে, প্রবীণ ভোটারদের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। এক্ষেত্রে হ্যারিস কিছুটা বেশি সমর্থন পেয়েছেন।
গ্রামীণ এলাকায় ট্রাম্পের সমর্থন পুনরুদ্ধার
২০২০ সালে গ্রামাঞ্চলে কিছুটা সমর্থন হারানোর পর, ট্রাম্প ২০২৪ সালে সেখানে পূর্ণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছেন। শহরগুলো এখনো ডেমোক্রেটদের কাছে রয়ে গেছে। কিন্তু উপশহরগুলোতে সমর্থন এবার পুনরায় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকে গেছে।
মধ্যপন্থি ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের প্রভাব
২০১৬ থেকে ২০২৪ সালে মধ্য, উদার ও রক্ষণশীলরা রিপাবলিকান দলের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। মধ্যপন্থি ভোটারদের অধিকাংশ এবারও ডেমোক্রেটিক প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু তা আগের তুলনায় কম ছিল।
ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা স্পষ্ট ছিল। যারা মূলত রিপাবলিকান দলের বিরোধিতার কারণে ভোট দিয়েছেন, তারা হ্যারিসকে সমর্থন দিয়েছেন।
নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ট্রাম্পের সফলতা
ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নতুন ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। এই নতুন ভোটাররা সাধারণত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেন না। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ট্রাম্প তাদের কাছে বেশি সমর্থন পেয়েছেন। তবে, ২০২৪ সালে প্রথমবার ভোট দেয়া ভোটারদের সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় কম ছিল।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় এবং তার নির্বাচনি কৌশলগুলো আমেরিকার রাজনীতির গতিপথ এবং ভোটের হিসাব-নিকাশে পরিবর্তনকে স্পষ্ট করেছে। অতীতের তুলনায় ট্রাম্পের নির্বাচন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড় নিয়ে এসেছে। যা পরের নির্বাচনি লড়াইগুলোর জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করবে।