ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এক কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি অংশে রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেছিলেন তিনি। হাসান রুহানির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
৬৩ বছরের এই সাবেক বিচার বিভাগীয় প্রধান ব্যাপকভাবে জয়ী হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। তিনি এমন একটা সময়ে প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করেন যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনাসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
রাইসি দায়িত্বভার গ্রহণের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরান। তার মধ্যে ২০২২ সালে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, গাজায় ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ অন্যতম। আর গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়েই ইরান ও ইসরায়েলের ছায়াযুদ্ধ প্রকাশ্যে চলে আসে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। ছবি: সংগৃহীত
ইব্রাহিম রাইসির কর্মজীবন বেশ ঘটনাবহুল। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছিল। খুব অল্প বয়সে সাফল্য পান তিনি। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে কট্টর পন্থার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি। এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক তার জীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো।
ব্যক্তিগত জীবন
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। তার বাবাও ধর্মগুরু ছিলেন।
শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ইসলামের নবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন রাইসি।
আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন রাইসি। শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন তিনি।
সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ-এর শাসনের পতন ঘটে।
ছাত্র অবস্থা থেকেই ইব্রাহিম রাইসিকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনি ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।
রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে।
তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুমার নামাজ পরিচালনা করেন।
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। ছবি: সংগৃহীত
৪০ বছরের বিচার বিভাগীয় অভিজ্ঞতা
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। বিপ্লবের পর সবগুলো বছরই তিনি বিচারিক পদে কাজ করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যখন জেনারেল প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে তিন বছর আগে আস্তান কুদস রাজাভির দায়িত্ব নেন, সেই সময়েও তিনি বিশেষ করণিক আদালতের কৌঁসুলি ছিলেন।
তার নির্বাচনি বিতর্ক এবং প্রচারাভিযানের সময় বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিজের কর্মকাণ্ডকে ‘সফল’ হিসেবে দাবি করলেও, অনেকেই মনে করেন তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন বিচার ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিশেষত, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ছবিটা তার পূর্বসূরিদের চেয়ে খুব একটা আলাদা ছিল না।
মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং সাজা দেয়া, পরিবেশ কর্মীদের লাগাতার আটক করা, নাভিদ আফকারি এবং রুহুল্লাহ জামসহ একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের মতো বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে তার সময়কালে।
পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট এবং মেসেঞ্জার বন্ধ করে দেয়া, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের মতো ঘটনাও তার দায়িত্বে থাকার সময়েই ঘটেছে বলে অভিযোগ।
প্রসঙ্গত, বিচার বিভাগে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইব্রাহিম রাইসি যেসব দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলোর জন্য দায়বদ্ধ থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন তার এক বক্তব্যে। যদিও অনেকেই মনে করেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যে দীর্ঘ তালিকা রয়েছে তার নিরিখে জনতাকে বোঝানোর কাজটা সহজ নয়।
২০১৯ সালে প্যারিসে ইরানের বিরোধীদলীয় কর্মীরা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের স্মরণ করেন। ছবি: সংগৃহীত
‘ঘাতক কমিটি’র সঙ্গে যোগ
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই সাফল্য অর্জন করেছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৮৮ সালে এক গোপন ট্রাইব্যুনাল বসে, যা ‘ঘাতক কমিটি’ নামে পরিচিত ছিল। ওই ট্রাইব্যুনালের চার বিচারপতির একজন ছিলেন রাইসি। তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি পদে থাকাকালীনই ওই ট্রাইব্যুনালের অংশ ছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যে জেলে সাজা ভোগ করছেন এমন হাজার হাজার বন্দির ‘পুনর্বিচার’ করার জন্য বসানো হয়েছিল ওই ট্রাইব্যুনাল। এই সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থী বিরোধী দল মুজাহেদিন-ই খালকের (এমইকে) সদস্য, যা পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন অফ ইরান (পিএমওআই) নামেও পরিচিত।
ট্রাইব্যুনালে কতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর তথ্য অনুযায়ী প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর তাদের গণকবর দেওয়া হয়। সমাধি আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এই ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেই মনে করা হয়।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের নেতারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি অস্বীকার করেন না। তবে তারা আলাদাভাবে মামলাগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাও করতে চান না। এর আইনি বিষয়েও কোনো কথা বলতে চান না তারা।
রাইসি অবশ্য এই মৃত্যুদণ্ডে তার ভূমিকার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন। তবে একইসঙ্গে এটাও দাবি করে এসেছেন যে, আয়াতুল্লাহ খোমেনির ফতোয়া বা ধর্মীয় বিধানের কারণে এগুলো ন্যায়সঙ্গত হয়েছে।
২০১৬ সালে রাইসি, বিচার বিভাগের কয়েকজন সদস্য ও তৎকালীন ডেপুটি সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ হোসেন আলী মোন্তাজারির (১৯২২-২০০৯) মধ্যে বৈঠক চলাকালীন কথোপকথনের একটা অডিও টেপ ফাঁস হয়ে যায়।
অডিও টেপে মোন্তাজেরিকে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করতে শোনা যায়। এক বছর পর আয়াতুল্লাহ হোসেন আলী মোন্তাজারি খোমেনির মনোনীত উত্তরসূরি হিসেবে তার পদ হারান এবং খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি সর্বোচ্চ নেতা হন।
২০২১ সালে গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে তার ভূমিকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে রাইসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘একজন বিচারক, একজন কৌঁসুলি যদি জনগণের সুরক্ষা করে থাকেন তবে তার প্রশংসা করা উচিত...। আমি এ পর্যন্ত যেসব পদে ছিলাম সেখানে মানবাধিকার রক্ষা করতে পেরে আমি গর্বিত।’
আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভির দায়িত্ব
রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি। তিনি ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলি (প্রসিকিউটার জেনারেল) পদের দায়িত্ব পান।
দু’বছর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে।
এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাশহাদে অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার দরগা রক্ষণাবেক্ষণ করে।
এছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের দাতব্য এবং অন্যান্য সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণকাজ, কৃষি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক ব্যবস্থাসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব এই সংস্থার হাতে রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইব্রাহিম রাইসির পক্ষে প্রচারণা। ছবি: সংগৃহীত
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও রাইসিকে নিয়ে বিতর্ক
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন রাইসি। ওই নির্বাচনে অবশ্য তিনি জেতেননি। জিতেছিলেন ধর্মীয় নেতা হাসান রুহানি, যিনি প্রথম দফায় ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরা ইব্রাহিম রাইসি ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পান ওই নির্বাচনে।
রাইসির বিরুদ্ধে রুহানির অভিযোগ ছিল, বিচার বিভাগের ডেপুটি প্রধান হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতির মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি প্রায় কিছুই করেননি।
তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুহানির কাছে পরাজয় রাইসির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারেনি। ২০১৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে দেশের বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে অধিষ্ঠিত করেন।
এরপরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস বা বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে ৮৮ ধর্মীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ।
বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসাবে ইব্রাহিম রাইসির সময়কালে বিচার ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার হয়েছে। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা কমেছে এবং অবৈধ মাদক সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যাও কমেছে বলে দাবি করা হয়।
যদিও পরিসংখ্যান বলছে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও বিশ্বে চীনের পরের স্থানই ইরানের। শুধু তাই নয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করতে বিচার বিভাগ হাত মিলিয়েছে নিরাপত্তা বিভাগের সঙ্গে। তারা যৌথভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এবং বিদেশে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি আছে এমন ইরানিদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মামলাও দিয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের নিরিখে ২০১৯ সালে রাইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাইসির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের যে তালিকা রয়েছে, সেখানে এমন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অভিযোগ রয়েছে যারা কথিত অপরাধের সময় নাবালক ছিলেন।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার সময় রাইসি দেশের নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপমান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্বতন্ত্র মঞ্চে এসেছেন বলে দাবি করেন।
নির্বাচনের চিত্র দ্রুত বদলে যায় যখন কট্টরপন্থী গার্ডিয়ান কাউন্সিল বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মধ্যপন্থী ও সংস্কারবাদী প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করে। ভিন্নমতাবলম্বী ও কিছু সংস্কারপন্থী ভোটারদের নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানান। তাদের অভিযোগ ছিল, রাইসি যাতে বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি না হন তা নিশ্চিত করতে পুরো বিষয়টা সাজানো হয়েছে।
প্রথম দফায় ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি জয় নিশ্চিত করতে পারেন। তবে ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৯ শতাংশের কিছু কম, যা ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে সর্বনিম্ন।
ইব্রাহিম রাইসি ওই বছরের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রপতি হিসাবে চার বছরের মেয়াদ শুরু করার সময় দেশের সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যে কোনো কূটনৈতিক পরিকল্পনা সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।
তার ইঙ্গিত ছিল ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে ২০১৫ সালের চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনার দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তি নিয়ে কোনো ইতিবাচক উত্তর পায়নি ইরান। এরপর থেকে ইরান ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে পাল্টা জবাব দিয়েছে।
রাইসি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার পাশাপাশি তাদের আঞ্চলিক তৎপরতা রক্ষার অঙ্গীকার করেন এবং নিজেদের স্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
আলোচনায় রাইসির কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও ২০২২ সালের আগস্টে পরমাণু সমঝোতা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল বলে জানা গেছে। যদিও তৎকালীন সময়ে ইরানের পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
মাহসা আমিনিরি ছবি নিয়ে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত
সরকারবিরোধী বিক্ষোভ
ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ধর্মীয় শাসনের অবসানের দাবিতে গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান।
সঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে তেহরানে নীতি পুলিশের হাতে আটক মাহসা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যু জন্ম দেয় এক আন্দোলনের, যার নাম ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’। কর্তৃপক্ষ ওই তরুণীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কথা অস্বীকার করলেও জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান অনুযায়ী শারীরিক অত্যাচারের ফলে মৃত্যু হয়েছিল মাহসা আমিনির।
বিক্ষোভকারীদের বল প্রয়োগ করে দমন করা হয়েছিল। এই ঘটনায় নিহতের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ না করলেও জাতিসংঘ মিশন জানিয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৫৫১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের দাবি, নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৫ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
২০ হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয় এবং নয় যুবককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভ প্রশমিত করা গেলেও, হিজাব আইন নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ অব্যাহত ছিল। ইরানের সংসদ এবং রাইসি নতুন আইন এনে যে সমস্যার মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, তার জবাবে অনেক নারী জনসমক্ষে তাদের চুল ঢেকে রাখা বন্ধ করে দেন।
ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ছবি: সংগৃহীত
আঞ্চলিক উত্তেজনা
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সাত বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে রাইসি সরকার ইরানের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক সুন্নি শক্তি সৌদি আরবের সঙ্গে আকস্মিক সমঝোতা করতে রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে আন্তঃসীমান্ত হামলা চালালে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে।
একই সময়ে লেবাননের হেজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন মিলিশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শনের জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে।
এই উত্তেজনা বৃদ্ধি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে- এমন আশঙ্কা এপ্রিলে আরও জোরদার হয় যখন ইরান প্রথমবার সরাসরি সামরিক হামলা চালায় ইসরায়েলে।
সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন মি. রাইসি।
ইসরায়েল এর জবাবে ইরানের একটি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সেই আক্রমণ অবশ্য তার সরকারকে বিচলিত করতে পারেনি বলে উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঁধ উদ্বোধনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়ে রাইসি বলেন, ‘ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম ইস্যু’।
সূত্র: বিবিসি বাংলা