ফসলের নির্ধারিত দাম ও একাধিক দাবিতে রাজধানী দিল্লির অভিমুখে রওনা হয়েছেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার এক লাখের বেশি কৃষক। তাদের যে কোনো মূল্যে আটকাতে মরিয়া হরিয়ানার প্রাদেশিক সরকার। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে ব্যবস্থা।
মঙ্গলবার সকালে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে কৃষকদের বিশাল ওই মিছিল। দুপুর গড়াতেই পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তের শম্ভু এলাকায় কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করতে ড্রোন থেকেও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে পুলিশ। ব্যবহার করা হচ্ছে জলকামান।
এনডিটিভির খবর অনুসারে, ২০২০ সালের স্মৃতি ফিরিয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের অন্তত ২০০টি কৃষক সংগঠন দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন লক্ষাধিক কৃষক।
মিছিলে অন্তত দুই ডজন শেল ছোড়া হয়েছে। কৃষকদের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি ছাড়াই তাদের আক্রমণ করা হয়েছে বলে সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
কৃষকের ঢল রুখতে দেশটির সিঙ্ঘু, টিকরি ও গাজিপুর সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লি পুলিশ। ব্যারিকেড আর কাঁটাতার দিয়ে পথ আটকে দেয়া হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা যাতে অন্যান্য জেলা থেকে হরিয়ানায় ঢুকতে না পারেন, সেই উদ্দেশ্যে ওই রাজ্যের সীমানায় পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে; অতিরিক্ত ৫০ কোম্পানি পুলিশ মোতায়েন করেছে রাজ্য সরকার।
আনন্দবাজারের খবর অনুযায়ী, হরিয়ানার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে হরিয়ানার মনোহর লাল খট্টর সরকার। এ বিষয়ে বিজ্ঞিপ্তিও জারি করেছে প্রশাসন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অম্বালা, কুরুক্ষেত্র, কইথাল, জিন্দ, হিসার, ফতেহাবাদ এবং সিরসা জেলায় মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মোবাইলের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে। গ্রাহকেরা শুধুমাত্র ভয়েস কল করতে পারবেন।
কৃষকেরা বিক্ষোভের ডাক দেয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে দুটি স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলে রূপান্তর করেছে হরিয়ানা সরকার। কৃষকদের মিছিল থেকে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের আটক করে ওই দুটি জেলে রাখা হবে বলে জানিয়েছে সংবাদ প্রতিদিন।
সতর্ক দিল্লি
কৃষকদের মিছিল নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে দিল্লি সরকারও। দিল্লির প্রবেশমুখগুলোর জায়গায় জায়গায় কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে, বসানো হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, পেরেকের পাটাতন; মোতায়েন রয়েছে বিশাল পুলিশবাহিনী।
কৃষকদের কর্মসূচির আগেই সোমবার দিল্লিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এক মাস অর্থাৎ, আগামী ১২ মার্চ পর্যন্ত তা চলমান থাকবে দেশটির রাজধানীতে।
বিরোধী দলগুলোর অবস্থান
কৃষকদের দিল্লিতে ঢুকতে বাধা দিতে সরকারের গৃহীত সব রকম ব্যবস্থার জন্য কঠোর সমালোচনা করেছে দেশটির বিরোধী দল এবং কৃষক সংগঠনগুলো।
দিল্লি সীমানায় পেরেক বসানোর একটি ভিডিও শেয়ার করে কংগ্রেস নেতা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “কৃষকের পথে পেরেক-কাঁটা বিছানো। এটা কি ‘অমৃতকাল’ না কি ‘অন্যায়কাল’?”
রাস্তা আটকানোর চেষ্টায় রাজ্য সরকারকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সম্মিলিত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম) নেতা জগজিৎ সিংহ ডালেওয়াল। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘সরকার ভয় পাচ্ছে কেন? বিশাল ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছে। এটাই কি গণতন্ত্র? পরিস্থিতি খারাপ হলে এর দায়ভার খট্টর সরকারকেই নিতে হবে।’
দিল্লি ও হরিয়ানায় প্রবেশপথগুলোকে ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখার সঙ্গে তুলনা করেছেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির নেতা ভগবন্ত মান।
তার ভাষ্য, ‘কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দাবি মেনে নিতে আমি কেন্দ্রকে অনুরোধ করছি। পাকিস্তান সীমান্তের মতো দিল্লি যাওয়ার রাস্তাগুলোতে তার লাগানো রয়েছে।’
কৃষকদের দাবি ও সরকারের অবস্থান
ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) গ্যারান্টি দেয়ার আইন, কৃষকদের জন্য পেনশন, শস্যবিমা এবং তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষক নেতারা।
একাধিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ২০০টির বেশি কৃষক সংগঠন আন্দোলনে শামিল হয়েছে। শুধু ওই তিন রাজ্য নয়, আশপাশের রাজ্যগুলো থেকেও কৃষকরা এ আন্দোলনে শামিল হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার সকালেই তাদের একটি দল দিল্লি অভিমুখে রওনা হয়। এ ঘটনায় আবারও ভারতের রাজধানী উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য কৃষক সংগঠনগুলোকে আলোচনায় বসার ডাক দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কৃষকদের আন্দোলন রুখতে দুদিন আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া করা শুরু করেছে হরিয়ানা সরকার।
প্রেক্ষাপট
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবিতে গত ডিসেম্বর থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন উত্তরপ্রদেশের নয়ডা এবং গ্রেটার নয়ডার কৃষকেরা। কিছুদিন আগে সেখানকার কৃষকেরা কিষাণ মহাপঞ্চায়েতের ডাক দেন। সেই সম্মেলনে নিজেদের দাবি আদায়ে তারা মিছিল করে সংসদ পর্যন্ত যাবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
গত বৃহস্পতিবার মিছিল করে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের একাংশের। তার আগেই উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লিতে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। ২৪ ঘণ্টার জন্য ওই ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা ভারত। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে লাগাতার আন্দোলন চলে সে সময়। সেই আন্দোলনের জেরে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে নরেন্দ্র মোদি সরকার। পরে বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহার করা হয়।