পাকিস্তানে নির্বাচন তো হলো। এবার সরকার গঠন করবে কারা, কোন পথে? ইমরান খানের নেতৃত্বের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এই প্রশ্নকে বড় করে তুলেছে। কারাবন্দি ইমরান খানের দল এখন কোন পথে এগোবে? তাদের সামনে বিকল্প কী?
ইমরান খানের দলটি নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে পারলেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বড় বাধার মুখে পড়েছে। কারণ দেশটির নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দলটিকে বাতিল ঘোষণা করেছে। পিটিআই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ না পাওয়ায় দলটির নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটের মাঠে লড়েছেন।
‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদ ভুলতে চান ইমরান’
অতীতের তিক্ততা অতীতেই রাখতে চান পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান। শনিবার ইমরানের বরাত দিয়ে এমনটা জানান তার আইনজীবী উমাইর খান নিয়াজি।
আদিয়ালা কারাগারের বাইরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইমরান খান কেন্দ্রে ফেডারেল সরকার এবং পাঞ্জাব ও খাইবার-পাখতুনখোয়ায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে চান।
পেশায় আইনজীবী নিয়াজি ইমরানের খুবই ঘনিষ্ঠ একজন নেতা। নির্বাচনে তিনি ইমরান খানের আদিনিবাস মিয়ানওয়ালি থেকে জাতীয় পরিষদের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
নিয়াজি জানান, বিশেষ শক্তিগুলোর প্রতি (সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ) নওয়াজ শরিফকে জোট সরকার গঠন না করতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইমরান। কারণ, অতীতে (নওয়াজকে নিয়ে) এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কখনই কার্যকরী হয়নি।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত
নিয়াজি জানান, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অতীতের তিক্ততা, বিরোধের কথা ভুলতে রাজি আছেন পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা।
একইসঙ্গে, ভোটের ফলাফলে পিটিআইয়ের সদস্য যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত ঘোষণা করা হয়েছে, রোববার তাদেরকে নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় বিক্ষোভ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
ইমরানের এই সবুজ সংকেতের পর সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে পিটিআই। সরকার গঠনে নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলের কোর কমিটি এক সভা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে, পিটিআইয়ের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে উমাইর নিয়াজিকে নির্দেশ দিয়েছে কমিটি।
আলী আমিন গান্দাপুর এবং মিয়াঁ আসলাম ইকবাল নামের আরও দুই সিনিয়র নেতাকে খাইবার পাখতুনখোয়া ও পাঞ্জাবে প্রাদেশিক সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দেয়া হয়।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিটিআই এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গওহর আলী খানসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা আশাপ্রকাশ করেন যে, নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা জেতায় প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পিটিআইকে সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন।
পার্লামেন্টে ২৬৬টি আসনের মধ্যে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ২৬৪টি আসনে। বাকি দুটি আসনের একটিতে প্রার্থী গুলিতে নিহত হওয়ায় নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। অপর আসনটির ভোটগ্রহণ শেষ হবে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে।
নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ন্যূনতম প্রয়োজন ১৩৪টি আসন। সব আসনের ফল ঘোষণার পর দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ১০১টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর মধ্যে ৯৩ জনই ইমরান খান ও তার দল পিটিআই সমর্থিত প্রার্থী।
নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পেয়েছে ৭৫টি আসন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি পেয়েছে ৫৪টি আসন।
এছাড়া মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-এমকিউএম ১৭টি, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) তিনটি আসনে জয় পেয়েছে।এবং বাকি আসনগুলোতে বিভিন্ন ছোট দল জিতেছে।
পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সেটা এককভাবে সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়।
কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এক্ষেত্রে সরকার গঠনে দলগুলোর জোট গঠনের বিকল্প নেই।
সরকার গঠন নিয়ে ইতোমধ্যে জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। আর এক্ষেত্রে বেশি তৎপর পিএমএল-এন দলের।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের মধ্যেই লাহোরে দলের প্রধান কার্যালয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে নওয়াজ শরিফ জোট গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এজন্য তারা অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা বলছেন।
পিএমএল-এন এর আগে পিপিপির সঙ্গে জোট গড়েছিল। সে সুবাদে ক্ষমতায় বসেছিল তাদের জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট আপাতত ভিন্ন মনে হচ্ছে। জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে পিপিপি সতর্ক। দলটির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো বহুবার বলেছেন যে তার দল নওয়াজ শরীফের দলে (পিএমএল-এন) যোগ দেবে না।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত পিএমএল-এন এবং পিপিপি একসঙ্গে সরকার গঠন করতে পারে। এমনকি অন্যান্য দলকেও জোটে ভেড়াতে পারে।
পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য বিকল্প কী?
পাকিস্তানের নির্বাচনি আইন অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইচ্ছা করলে স্বতন্ত্র হিসেবে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদে থাকতে পারেন। কেননা তাদেরকে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করতেই হবে এমন কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
তবে বিজয়ী হওয়ার পর এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হাতে তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টা সময় থাকে। কোনো দলে ভেড়ার ইচ্ছা থাকলে তা এই সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
আবার নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কেবল সেই দলে যোগ দিতে পারবেন যাদের নির্বাচনি প্রতীক ব্যালটে দেয়া হয়েছে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে অযোগ্য ঘোষণা করায় কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী এই দলে যোগ দিতে পারবেন না। তাই পিটিআইকে সমর্থন দেয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোন দলে যোগদান করবেন তা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিতরা ইতোমধ্যে নওয়াজের পিএমএল-এন এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি থেকে যোগদানের প্রস্তাব পাচ্ছেন।
জোট সরকার গঠন নিয়ে আলোচনায় পিপিপি ও পিএমএল-এন নেতারা। ছবি: সংগৃহীত
এখন দেখার বিষয় পিটিআই-এর নাম ও সমর্থন নিয়ে জয়ী হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইমরান খানের প্রতি অনুগত থাকেন কিনা। কারণ আইন অনুযায়ী কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী পার্লামেন্টে আসন পেলে দলের নিয়ম মানতে তারা বাধ্য নন।
কোনো দলে যোগ না দিলে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই পার্লামেন্টে থাকবেন। এক্ষেত্রে তারা জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ পেতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ফারুক হাসনাত বলছেন, ‘পিটিআই-এর স্বতন্ত্র সদস্যদের অন্য দলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ এই প্রার্থীরা জানেন যে দলের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করলে এর পরিণতি তাদের পূর্বসূরিদের মতোই হবে।’
তবে ভিন্ন কথা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রসুল বখশ রইস। তার মতে, পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে বিক্রি হয়ে যেতে পারেন। কেউ কেউ তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করতে পারেন।
সরকার গঠনে এগিয়ে কারা
নির্বাচনের মাঠে পিটিআই এগিয়ে থাকলেও সরকার গঠনে তৎপরতা বেশি নওয়াজ শরীফের পিএমএল-এন দলের।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বড় প্রভাব রয়েছে। সে হিসেবে এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী নওয়াজ শরিফ পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
তবে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা এমন এক অবস্থায় আছেন যেখানে একটি সরকার গঠন করা বেশ কঠিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে পিটিআইয়ের সামনে দুটি পথ রয়েছে। এক, পিটিআইপন্থী প্রার্থীরা একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর আকারে থাকতে পারেন। দুই, তারা চাইলে বিলাওয়াল ভুট্টোর দল বা অন্যান্য ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারেন।
তবে জিও নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পিটিআই চেয়ারম্যান গহর আলী খান জানিয়েছেন, তারা পিএমএল-এন বা পিপিপির সঙ্গে জোট করবেন না।
আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চাইলে নিজেরাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারবেন। তবে এজন্য তাদের ১৩৪টি আসন থাকতে হবে।
রফিউল্লাহ কাকার বলছেন, এ নিয়ে আইনে কোনো বাধা নেই। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিজেদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করাকে বাস্তবসম্মত মনে করা যায় না।
সংরক্ষিত আসন পেতে অযোগ্য পিটিআই
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ৭০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। যে দল যতো বেশি আসনে জয় পাবে তার দল ততো বেশি সংরক্ষিত আসন পাবে।
সে হিসাবে নওয়াজ শরিফের দল ২০টির বেশি আসন পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে পাকিস্তানের নির্বাচনি আইনের অধীনে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পার্লামেন্টের ওই ৭০টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য নন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অসুবিধা। এক্ষেত্রে পিটিআইয়ের সামনে একটি পথ হল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো দলে যোগ দেয়া।