সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নাবালিকা ধর্ষণ মোকাবিলায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে চলেছে ভারত সরকার। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো অপরাধের সাজা ২০ বছর কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন, এমনকি মৃত্যুদণ্ড করতে একটি নতুন বিল উত্থাপন হয়েছে দেশটির লোকসভায়।
মূলত ব্রিটিশ আমলে তৈরি একাধিক আইন বাতিল করে তার পরিবর্তে নতুন আইনের প্রস্তাব দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শুক্রবার লোকসভায় এ-সংক্রান্ত নতুন বিল পেশ করেন তিনি।
প্রস্তাবিত আইনে গণপিটুনিতে হত্যায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নাবালিকা ধর্ষণের মতো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে।
তবে আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নতুন এ বিল দেশটির সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে বলে টিআরটির খবরে বলা হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের দণ্ডবিধি, পুলিশ ও আদালত পরিচালকারী আইনগুলো প্রবর্তিত হয় এখনও যা দিয়ে চলছে দেশটির বিচারব্যবস্থা। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও তাদের শাসনামলে ভারতীয়দের দাসত্বের চিহ্ন মুছে ফেলতেই নতুন আইন প্রবর্তন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অমিত শাহ।
আনন্দবাজারের তথ্যানুযায়ী, ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’, ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড’ এবং ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’-এর নাম বদলে হতে চলেছে যথাক্রমে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা (বিল), ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিল) এবং ভারতীয় সাক্ষ্য (বিল)।
ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করাই তার লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত ওই আইনে দেশদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহের চিরায়িত আইনটিও আর থাকছে না বলে জানিয়েছেন অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, ভারতীয় পেনাল কোডের ১২৪ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের যে ধারাটি ছিল, তা বাতিল করা হচ্ছে। নতুন বিলে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে এমন কাজ করলে যথোপযুক্ত শাস্তি হবে।
আইনগুলো পরিবর্তনের কারণ কী?
লোকসভার অধিবেশনে অমিত শাহ বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসনামলে যে আইনগুলো করা হয়েছিল, সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের মাটিতে ইংরেজ শাসন আরও পাকাপোক্ত করা। ভারত এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। তাই অন্যের চাপিয়ে দেয়া আইনগুলো এমনিতেই টিকে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে।
‘ইংরেজদের প্রবর্তিত এসব আইনের উদ্দেশ্য ছিল শাস্তি দেয়া, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনের উদ্দেশ্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা, শাস্তি দেয়া নয়, বরং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দেশের জনগণকে নিরুৎসাহিত করা।
‘আইনগুলো পাশ হলে দেশের বিচার ব্যবস্থা আরও সুসংহত হবে। মানুষের মনের অপরাধপ্রবণতা বন্ধ করার বিষয়টি মাথায় রেখেই আইনগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে।’
নতুন আইনগুলো পাশ হলে ভারতের ফৌজদারি আইনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন শাহ। তিনি বলেছেন, আইনগুলো পাশ হলে সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যেই ন্যায়বিচার পাবেন ভুক্তভোগী।
যেসব বিলে আসছে পরিবর্তন
• বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ (এ) ধারায় রয়েছে দেশদ্রোহ বিষয়ক আইন। নতুন বিলে তা পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতা বিপন্ন হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই গণ্য করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম শাস্তি তিন বছর থেকে বৃদ্ধি করে সাত বছর করা হয়েছে।
• প্রস্তাবিত বিলে ধর্ষণে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে ন্যূনতম ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে তা কমপক্ষে ২০ বছরের কারাদণ্ড থেকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
• ১২ বছরের কম বয়সী নাবালিকাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রেও অপরাধীর সর্বনিম্ন ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়েছে। ১২ বছরের কম বয়সি নাবালিকাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
• গণপিটুনির অপরাধে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে।
• ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এর আগে সন্ত্রাসের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল না। অমিত শাহের প্রস্তাবিত নতুন বিলে একে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সন্ত্রাসের শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড করার প্রস্তাব করেছেন শাহ।
• প্রথমবারের মতো সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকে শাস্তি হিসেবে গণ্য করতে প্রস্তাব রাখা হয়েছে বিলে। এর ফলে শাস্তি হিসেবে অপরাধীকে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের আাদেশ দিতে পারবে দেশটির আদালত।
• প্রস্তাবিত বিলে একটি নতুন বিধানও আনা হয়েছে। নতুন এই বিলে মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হতে পারে এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে শাস্তি দেয়ার প্রথম সাত বছরের মধ্যে ক্ষমা করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে অমিত শাহের ব্যাখ্যা, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার শাস্তি মওকুফ করতে এ আইনটির অপব্যবহার করে। তা রুখতেই নতুন এ বিধান।