যে করেই হোক দাঁড়াতে হবে পরিবারের পাশে। দরকার অর্থ। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের বাসিন্দা আবদুর মনে এ অনুভূতি আসে ২০২০ সালের শুরুতে।
দেরি না করে ২৫ বছরের এ যুবক ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেন রাজধানী শহর সানা থেকে উত্তরে।
‘হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তাই বছরের শুরুতে কাজের সন্ধানে সৌদি আরব যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই’, বলেন আবদু।
বিদ্রোহী দমনে ধনী প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরব বছরের পর বছর ধরে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইয়েমেনে।
হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় সৌদি আরবে ওয়ার্ক ভিসার আবেদন করেননি আবদু। সৌদির দক্ষিণের শহর খামিস মুশাইত ছিল তার গন্তব্য। অন্য অনেকের মতো, ১২ ঘণ্টার এ যাত্রায় তিনি পাচারকারীদের সাহায্য নেন।
এ নিয়ে আবদু বলেন, ‘২০২২ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সেখানে পৌঁছাই। ৪১ হাজার টাকায় রাখালের কাজ নিই।’
২০২২ সালের এপ্রিলে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ইয়েমেন সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। এর ফলে সৌদি বিমান হামলাও বন্ধ হয়ে যায়; অনেকাংশে কমে যায় যুদ্ধ। দীর্ঘদিন চলা সংকট সাময়িকভাবে কাটিয়ে ওঠেন সাধারণ ইয়েমেনিরা।
বারবার লঙ্ঘন সত্ত্বেও ছয় মাসের জন্য যুদ্ধবিরতিটি কার্যকর ছিল। এ সময়ে হুতি নিয়ন্ত্রিত হোদেইদাহ বন্দরে জ্বালানি জাহাজ আসা চার গুণ বেড়ে যায়। সানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো ২০১৬ সালের পর প্রথমবারের মতো ফের চালু হয়। এতে হাজার হাজার যাত্রী, বিশেষত রোগী ও শিক্ষার্থীরা বিদেশে যেতে কিংবা দেশে ফিরতে পারেন।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী, সংঘাত বন্ধ হওয়ায় শিশুমৃত্যুর হার ৩৪ শতাংশে নেমে যায়। বাস্তুচ্যুতির সংখ্যাও অর্ধেকে নামে।
আবদু বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবর শোনার পর বাবাকে ফোন করেছিলাম। তিনি খুব খুশি ছিলেন। কারণ জ্বালানি জাহাজ আসতে চলেছে। বিমান হামলা বন্ধ হয়েছে।
‘আমার বাবা বাসচালক। তার জন্য জ্বালানির দাম কমা অনেক বড় খবর। পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরবে ভেবে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি।’
বাবার সঙ্গে কথা বলার পর আর দেরি করেননি আবদু। জমানো ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
এ যুবক বলেন, ‘একটা পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরি। জমানো টাকায় একটা মিনিবাস কিনে সানায় থাকব। বাবার মতো বাসচালক হব।’
এখন পর্যন্ত ইয়েমেনে ফিরে আসা নিয়ে আবদুর অনুশোচনা নেই। কারণ যে পরিস্থিতিতে আবদু সানা ছেড়েছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেকটাই ভালো। যুদ্ধ মোটামুটি নেই বলেলেই চলে। জ্বালানিও পাওয়া যাচ্ছে প্রয়োজনমতো।
তারপরও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রায়ই ভাবায় আবদুকে। কখন আবার যুদ্ধে বেধে যায়, আবার কবে থেকে জ্বালানি সংকট দেখা দেবে, সে ভাবনায় ঘুম আসতে চায় না তার।
ভেস্তে গেল যুদ্ধবিরতি
গত বছরের অক্টোবরে ইয়েমেনে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হ্যান্স গ্রুন্ডবার্গ যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে ব্যর্থ হন। সরকার চাইলেও হুতিরা যুদ্ধবিরতিতে আর রাজি হয়নি।
এরপর সর্বাত্মক যুদ্ধে না জড়ালেও হুতিরা সরকার নিয়ন্ত্রিত হাদরামাউট গভর্নরেটের আল-ধাব্বা তেল টার্মিনালে ড্রোন হামলা চালায়। এতে ফের আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচনার শিকার হয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি।
ইয়েমেনের রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক আদেল দাশেলা জানান, ইয়েমেনে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা শেষ পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে।
নতুন বছরে তিনি ইয়েমেনের জন্য তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন।
এ গবেষকের ভাষ্য, ‘আঞ্চলিক শক্তিগুলো সর্বসম্মতভাবে ইয়েমেনের যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আলোচনায় বসতে চাপ দিতে পারে, তবে হুতিদের একগুঁয়েমি ও দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নমনীয়তার কারণে তা আলোর মুখ নাও দেখতে পারে।
‘দ্বিতীয়ত, স্থিতাবস্থার স্থায়িত্ব। হুতিরা ইয়েমেনের উত্তরে শাসন করছে আর সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দক্ষিণে। এই পরিস্থিতিতে সহিংসতার আশঙ্কা অনেক কম বলে মনে হচ্ছে, তবে এতে দেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব আরও শক্ত ও বিস্তৃত হবে।
‘সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়া হলো তৃতীয় দৃশ্যকল্প। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। এতে ইয়েমেন আরও বিধ্বস্ত হবে। মোটকথা, আঞ্চলিক পক্ষগুলোর আধিপত্যের কারণে ইয়েমেনে সহজে শান্তি ফিরবে না।’
উদ্বেগ নিয়েই স্বপ্ন দেখেন
এসব সত্ত্বেও আবদু এখনও মনে করেন, তার ইয়েমেনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবাজরা কয়েক মাস বা বছর ধরে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। এতে আমি কিছু মনে করব না। আমি কেবল যুদ্ধ বা জ্বালানি সংকটকে ভয় করি।
‘২০২২ সাল ভালোই কেটেছে। জানি না ২০২৩ সালে কী ঘটতে যাচ্ছে।’