বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পাকিস্তান-তালেবান সম্পর্কে ভাটা

  •    
  • ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:৪৭

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইনকে মেনে নেয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে কাবুল, যাতে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে স্পিন বোল্ডাক ও চামন শহরের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং ফের চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল পাকিস্তান, তবে ১৩ নভেম্বর আন্তসীমান্ত গোলাগুলিতে পাকিস্তানের এক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হলে সে প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।

এর কয়েক দিন পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে কাবুল সফর করতে দেখা যায়, যা আফগান তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের অবনতিশীল সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।

দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা

বিতর্কিত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তান দখলে নেয়ার পর থেকেই এ ধরনের সংঘর্ষ বেড়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানকে সীমান্ত সংঘাত বন্ধে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। কূটনৈতিকভাবে সংকট নিরসনের আহ্বানও জানিয়েছে ইসলামাবাদ, তবে পশতু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে যে অস্থিরতা বাড়ছে, সেটি ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের ডান্ড পাটানের কাছে ১৯ নভেম্বর তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীদের উত্তেজনার পর দেশটির মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী সাজিদ হোসেন তুরি টুইটারে লেখেন, ‘কুররাম সীমান্তে আফগানিস্তান আইন লঙ্ঘন করেছে। সীমান্তে বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্যবস্তু বানানো নিন্দনীয়।’

আফগানিস্তানে তালেবান শাসকরা ইসলামি শাসন কায়েম করেছে। তার পরও আফগানিস্তান-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো কাটছে না।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে ডুরান্ড লাইনকে মেনে নেয়ার বিষয়টি কাবুল প্রত্যাখ্যান করে আসছে, যাতে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।

ক্ষমতা দখলের পর স্বস্তিতে নেই আফগান শাসকরা। তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, মানবিক সহায়তা, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, নারী শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান প্রভিন্সের (আইএসকেপি) হুমকি মোকাবিলায় শক্ত চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

পাকিস্তানে যারা শরিয়া আইন চালু করতে চান, আফগানিস্তানের তালেবানকে দেখে তারা অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। ডুরান্ড লাইনের ওপারে আফগান তালেবানের হামলা নিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পাকিস্তানে এখন ‘জিহাদি বাহিনীর’ সমর্থন হু হু করে বাড়ছে।

যে আদর্শগত সংযোগ আফগানিস্তান তালেবানকে নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে, তা বুমেরাং হয়েছে। পাকিস্তানেই এখন ইসলামপন্থি মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

ইসলামপন্থি ও জিহাদি শক্তিগুলো এখন আর ভারতের বিরোধিতায় ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছে না। তারা এখন ইসলামি শাসন কায়েমের জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিচ্ছে।

পরিবর্তনশীল সম্পর্ক

তালেবানের ভারতবিরোধী নীতিতে লাভবান হচ্ছিল পাকিস্তান, তবে তালেবান এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায়। ভারতবিরোধী হয়ে সরকার চালানো সহজ হবে না, এমনটি ভালোভাবেই বুঝতে পারছে তারা। আফগানিস্তান পুনর্গঠনে ভারতের আর্থিক সহায়তাও চাইতে পারে তালেবান।

কাবুলের তালেবান-নেতৃত্বাধীন শাসনের প্রধান সুবিধাভোগী পাকিস্তান হলেও এটি ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, রাশিয়া, চীন, কাতারসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তালেবানকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছিল। আফগানিস্তান শাসনে পাকিস্তানের নির্দেশনা যে খুব একটা আমলে নেয়া হচ্ছে না, তালেবান সে ইঙ্গিত এরই মধ্যে দেয়া শুরু করেছে।

আফগানিস্তানে পাকিস্তানের জনপ্রিয়তা কমছে। এতে ইসলামাবাদের পুতুল হিসেবে নিজেদের দেখা এড়াতে শুরু করছে তালেবান।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এক ক্রিকেট ম্যাচে আফগানিস্তানের পরাজয় দুই জনগোষ্ঠীর শত্রুতাকে প্রকাশ্যে আনে, যার ফলে হতাশ আফগানভক্তরা পাকিস্তানি সমর্থকদের দিকে প্লাস্টিকের চেয়ার ছুড়ে মারার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তপ্ত বিতর্কে জড়ান।

কয়েক দশক ধরে শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানে অনেক আফগান বসবাস করে আসছে। সে বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে পাকিস্তানি সমর্থকরা পুরো আফগান জাতিকে নামাক হারাম (বিশ্বাসঘাতক) বলে অভিহিত করেছিল। জবাবে অনেক আফগান গোটা পাকিস্তানিদের ‘সন্ত্রাসী’ অ্যাখ্যা দেয়।

আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দুই দেশেই তালেবান আন্দোলনের কিছু শিকড় রয়েছে। মূলত পশতুন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখন ইসলামাবাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দারিয়েছে। তালেবান তাদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এই পশতুন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশেই তালেবান আন্দোলনের শিকড় রয়েছে। আর এই শিকড় হলো পশতু জাতিগোষ্ঠী। এই পশতুরা আবার তালেবানবিরোধীদের (ইসলামাবাদ) ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে তালেবান এখন পশতুদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করছে ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় আছে।

উজ্জীবিত পাকিস্তান তালেবান

আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে ব্যাপক খুশি পাকিস্তানি তালেবান বা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। তারা আফগান তালেবানকে রোল মডেল ঘোষণা করেছে।

শুধু তা-ই নয়, উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিজেদের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে টিটিপি সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানও শুরু করেছে।

পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে টিটিপির পাঁচ মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হয় গত ২৮ নভেম্বর। এর ঠিক দুই দিন পর বেলুচিস্তান প্রদেশে পুলিশের ট্রাকে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়, যাতে অন্তত তিনজন নিহত এবং ২০ নিরাপত্তাকর্মীসহ ২৮ জন আহত হন

হামলার দায় স্বীকার করে টিটিপি। তারা জানায়, আগস্টে আফগানিস্তানে তাদের সিনিয়র কমান্ডার আব্দুল ওয়ালি ওরফে ওমর খালিদ খোরাসানিকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলা চালানো হয়েছে।

এখন যেহেতু টিটিপির সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই, তাই টিটিপি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় প্রাণঘাতী হামলা আরও হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

টিটিপির সঙ্গে যুদ্ধবিরতিটি এমন সময়ে শেষ হয়, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আসছিল। জেনারেল আসিম মুনির আহমেদ সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। টিটিপির সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়ে মুনিরের নীতি কী হবে, তা এখন দেখার বিষয়।

পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী এখন টিটিপির সরাসরি হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। এতে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়ে অভিযোগ করতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তান সরকার।

এমন প্রেক্ষাপটে আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানের মধ্যে জোট আগের চেয়ে শক্তিশালী বলে মনে করা হচ্ছে। ডুরান্ড লাইনের ওপারে তাদের একীভূত হওয়ার লক্ষণও প্রবল হচ্ছে।

সীমান্তে পাকিস্তানের বেড়া নির্মাণকে মেনে নেয়নি আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান। তারা এ প্রকল্পকে ‘একতরফা’ ও ‘অবৈধ’ বলে বর্ণনা করে। ডুরান্ডলাইন বরাবর অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া তালেবান যোদ্ধারা সরিয়ে নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

পাকিস্তানের একটি থিঙ্ক ট্যাংকের মতে, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে অঞ্চলটিতে সন্ত্রাসী হামলা ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা দ্রুত অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।

পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় চাঁদাবাজি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ধনীদের পাশাপাশি স্থানীয় আইনপ্রণেতাদেরও তালেবান ব্ল্যাকমেইল করছে। গত কয়েক মাসে করাচিতে টিটিপির চাঁদাবাজি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

যদিও পাকিস্তানের নেতৃত্বে আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, আফগান তালেবান টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে, তবে আফগান তালেবান পাকিস্তানে তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কাজ করেনি।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত আইএস, আল কায়েদা, আইএসআইএল-কে এবং টিটিপির মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো পাকিস্তানকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে।’

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি সম্প্রতি শেহবাজের কথায় সুর মিলিয়েছেন

ওয়াশিংটনের ভূমিকা

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানের ওপর হোয়াইট হাউসের নির্ভরতা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। পাকিস্তান এখন আফগানিস্তানে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় একাধিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধে পাকিস্তান এখন আর ফ্রন্টলাইন রাষ্ট্র নয়। যদিও ২০২১ সালের আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের অসামঞ্জস্যতা ও অসংগতিগুলো কমিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদ।

ওয়াশিংটন ও কাবুলের মধ্যে সংলাপের সুবিধার্থে পাকিস্তানের ভূমিকার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন আফগানিস্তানে আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধি টমাস ওয়েস্ট।

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নিজেদের (আমেরিকার) ‘সামর্থ্যের’ ওপর জোর দেন।

পাকিস্তানি কূটনীতিক-বিশ্লেষকদের ভাষ্য

পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতারা এখন দাবি করেছেন, তারা আফগানিস্তানের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসছে, তবে এটা সত্যি যে ভারতের সামরিক হামলা প্রশ্নে আফগানিস্তানের ওপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল পাকিস্তান। এ কারণে আফগানিস্তানে ইসলামাবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে অনেকের সন্দেহ রয়েছে।

তালেবানের ক্ষমতা দখলের এক বছরেরও বেশি সময় পর সাবেক এক পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের উচিত আফগানদের আশ্বস্ত করা। তাদের বোঝাতে হবে, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই।’

পাকিস্তানের এক বিশ্লেষকও তার সরকারকে বলেছেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকা তালেবান আর অতীতে যে তালেবানকে ইসলামাবাদ মোকাবিলা করেছে, তারা এক নয়।

এ বিভাগের আরো খবর