বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আফ্রিকা যেভাবে আইএসের সেকেন্ড হোম

  •    
  • ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৮:২৫

দক্ষিণ সাভানা অঞ্চল থেকে উত্তরে সাহারা এবং সোমালিয়াকে আলাদা করেছে বিস্তীর্ণ শুষ্ক ভূমি সাহেল। এখানে মালি, বুরকিনা ফাসো এবং নাইজারের সীমানা মিলেছে। ত্রি-সীমান্ত এই অঞ্চলটিই এখন জঙ্গিদের হটস্পট। স্থানীয় লোকজন এখানে জঙ্গি হামলার শিকার হয়; তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।

সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের অন্যতম ধনী একটি এলাকায় বড় সমাবেশে সন্ত্রাসীরা হামলার পরিকল্পনা করছে বলে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ। অপ্রত্যাশিত এই সতর্কবার্তা সাউথ আফ্রিকার সরকারের পাশাপাশি দেশটির জনগণকেও অবাক করেছে। ফলাফল, জোহানেসবার্গের রাস্তায় পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি

সতর্কতাটি ছিল ২৯ অক্টোবর ঘিরে। তবে উত্তেজনায় পানি ঢেলে শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সাউথ আফ্রিকার সরকারও পরে ওই হুমকি নিয়ে আর কথা বলেনি।

তবে বিশেষজ্ঞরা এই সতর্কতাকে হালকাভাবে নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, সমস্ত কর্মকাণ্ড সাউথ আফ্রিকায় একটি অসম্ভাব্য-নীরব অপরাধকে ইশারা করছে...মধ্যপ্রাচ্যের উগ্রবাদী সংগঠন-আইএস।

ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের (আইএসএস) প্রধান বিশ্লেষক মার্টিন ইউই বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিশ্চিতভাবে হামলার প্রমাণ ছিল। এটি ছিল সুনির্দিষ্ট একটি সতর্কতা। কারণ, কখন এবং কোথায় হামলা হতে যাচ্ছে তা তারা প্রকাশ করেছিল। খুব কম সতর্কতায় এই ধরনের বিবরণ থাকে।’

শুরুতে সাউথ আফ্রিকা কর্তৃপক্ষ হুমকিটিকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। ২৯ অক্টোবর কোনো হামলা না হলেও, এই খবরে গোটা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়ে গেছে। যে ভয়টা করা হচ্ছিল সেটাই হয়েছে। সাউথ আফ্রিকায় ইতোমধ্যে তারা ঢুকে পড়েছে। আইএস একটি দ্রুত সম্প্রসারিত নেটওয়ার্ক। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে আফ্রিকাকে তারা তাদের দ্বিতীয় বাড়ি (সেকেন্ড হোম) বানিয়েছে।

আফ্রিকায় আইএসের উপস্থিতি মোজাম্বিকে সবচেয়ে চোখে পড়ে। সেখানে আইএস নেতা আহলু সুন্নাহ ওয়া জামা’আ (এএসডব্লিওজে) দেশটির ৩ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে; প্রায় ১০ লাখ মানুষকে করেছে বাস্তুচ্যুত। বিলিয়ন ডলারের গ্যাস বিনিয়োগের ওপর হুমকিও দিয়েছে৷

তবে প্রতিবেশী সাউথ আফ্রিকায় আইএস সমর্থকদের একটি উদীয়মান নেটওয়ার্ক। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ মুসলিম।

মোজাম্বিকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করতে বতসোয়ানা থেকে এসেছেন সামরিক কর্মীরা। ছবি: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ জেসমিন ওপারম্যান বলেন, ‘আইএসের হুমকি এখানে বাড়ছে। সাউথ আফ্রিকানরা আসলে বোকা। তারা জোর করে এটা বিশ্বাস করতে চাইছে যে তাদের সঙ্গে কখনোই এমন কিছু ঘটতে পারে না।

‘সাউথ আফ্রিকা সরকার বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছে। কয়েক বছর আগে ৬০ থেকে ১০০ সাউথ আফ্রিকান আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া এবং ইরাকে চলে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ ফিরে গেছেন।

‘আমাদের সজাগ হতে হবে, চোখ খুলে হুমকিটা দেখতে হবে।’

মধ্যপ্রাচ্যে ২০১৯ সালে আঞ্চলিক পরাজয়ের স্বাদ নেয় আইএস। তারপর থেকে তারা আফ্রিকায় পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। আফ্রিকায় থিতু হতে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, দুর্বল সীমান্ত ও শাসনের দেশগুলোকে বেছে নেয় আইএস।

ইউই বলেন, ‘আফ্রিকার অন্তত ২০ দেশের আইএসের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মধ্যপ্রাচ্যের পর আফ্রিকাকে একটি সক্রিয় হাব বানিয়েছে তারা।’

মধ্যপ্রাচ্যে আইএস খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তবে সেখানে ব্যাপক মার খেয়েছে সংঠনটি। আফ্রিকায় তাই কৌশল পাল্টেছে আইএস। সরাসরি শাসনে না গিয়ে স্থানীয় বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছে তারা। শুধু তা-ই নয়, ‘চিরশত্রু’ আল-কায়েদার সঙ্গেও আফ্রিকায় আঁতাত করেছে আইএস।

যেসব দেশ আইএস নির্মূলে দৃঢ় অবস্থানে ছিল, সংগঠনটির পুনর্গঠনের পর সেসব দেশও হতবাক হয়েছে। একসময় আইএস এবং আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফায়দা নিত নিরাপত্তা বাহিনীগুলো। আফ্রিকায় সেই দিনগুলো হয়তো শেষ হয়ে যাবে।

ইউই বলেন, ‘নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ। যখন জঙ্গিরা ইরাক এবং সিরিয়ায় ছিল তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়া সহজ ছিল।

‘কিন্তু এখন যখন তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি কীভাবে তাদের তাড়িয়ে দেবেন’?

২০১৪ সালের দিকে আফ্রিকা মহাদেশে ঢুকতে শুরু করে আইএস। মধ্যপ্রাচ্য কোণঠাসা হয়ে পড়লে তাদের মূল ফোকাস হয়ে উঠে আফ্রিকা৷ আফ্রিকান শাখাগুলো এখন মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিগুলোর চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে।

ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস করে আইএস । ছবি: আনাদোলু এজেন্সি

আইএসের পাশাপাশি আফ্রিকায় অনেকগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন সক্রিয়। তাদের কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছেই। পেন্টাগনের অর্থায়নে পরিচালিত আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অনুসারে, গত এক দশকে তাদের হামলার হার ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। জঙ্গি হামলায় গত বছর ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

দক্ষিণ সাভানা অঞ্চল থেকে উত্তরে সাহারা এবং সোমালিয়াকে আলাদা করেছে বিস্তীর্ণ শুষ্ক ভূমি সাহেল। এখানে মালি, বুরকিনা ফাসো এবং নাইজারের সীমানা মিলেছে। ত্রি-সীমান্ত এই অঞ্চলটিই এখন জঙ্গিদের হটস্পট। স্থানীয়রা এখানে জঙ্গি হামলার শিকার হন; তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।

এসব জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে অন্যতম ইসলামিক স্টেট গ্রেটার সাহারা-আইএসজিএস। ২০২২ সালে সাহেলে আনুমানিক ১ হাজার ২০০ বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় সংগঠনটি অভিযুক্ত।

লেক চাদ অঞ্চলে উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট পশ্চিম আফ্রিকা প্রদেশের (আইএসডব্লিওএপি) আধিপত্য রয়েছে। জুনে মূল সংগঠন আইএসআইএসকে নাইজেরিয়ায় হামলা চালাতে সহায়তা করেছিল আইএসডব্লিওএপি।

ইউই বলেন, ‘সোমালিয়া, লিবিয়া, মিশর এবং কঙ্গোয় তাদের সক্রিয় নেটওয়ার্ক রয়েছে। তানজানিয়া, নাইজার এবং কেনিয়ার তাদের শাখাগুলোকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আসলে প্রতিটি দেশই বিপদে আছে।’

সাউথ আফ্রিকার স্যান্ডটনে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহান্তে হামলা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো। সেদিন শহরে বার্ষিক কুচকাওয়াজের (প্রাইড মার্চ) আয়োজন ছিল; যেখানে যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। সেখান থেকে মাত্র ৩০ মিনিট দূরে আরেকটি সমাগমস্থল ছিল

জোহানেসবার্গে ‘প্রাইড মার্চ ২০২২’। ছবি: এলিজাবেথ সেজাকে

জোহানেসবার্গ প্রাইডের প্রতিষ্ঠাতা কায় অ্যালি বলেন, ‘কিছু হলে অনেক মানুষের জীবনে তা প্রভাব ফেলত। তারপরও আমরা সেখানে উপস্থিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

‘কোভিডের কারণে গত দুই বছর অনলাইনে আয়োজন হয়েছে। এবারও যদি আয়োজন বাতিল করি তবে তা হতো সন্ত্রাসীদের কাছে নতিস্বীকার করা।

‘পুলিশের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। নিরাপত্তাও ১০ গুণ বেশি ছিল। আমাদের কারও মনেই হয়নি যে আমরা বিপদে আছে।’

বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন প্রাইড মার্চ হতে পারে হামলার লক্ষ্য। সেখানে সাধারণত দেড় লাখ মানুষ উপস্থিত হন। নিরাপত্তা সতর্কতা ভাইরাল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং সাউথ আফ্রিকা সরকার অ্যালিকে হুমকির বিষয়টি জানিয়েছিল।

তবে অ্যালি দাবি করেন, তার ইভেন্টে সরাসরি হুমকি ছিল না।

‘যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগে ছিল। কারণ, তাদের কর্মীদের ইভেন্টে থাকার কথা ছিল। তারাও কিছু বলেনি।’

সাউথ আফ্রিকার ডারবান এবং কেপটাউনকে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, আইএসআইএস নেটওয়ার্কগুলো মোজাম্বিক এবং ডিআর কঙ্গোর শাখাগুলোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে বলে মনে হচ্ছে৷

ইউই বলেন, উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ সদস্য বৈধ ব্যবসায় জড়িত। এ কারণে তাদের আটক বা গ্রেপ্তার করা কঠিন। এখনও সন্দেহভাজনদের আটক বা সতর্কতার প্রতিক্রিয়া জানাতে খুব একটা সক্রিয় না সাউথ আফ্রিকা সরকার।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজের মন্তব্যের অনুরোধে সরাসরি সাড়া দেয়নি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইস ঘটনার পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস সাউথ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।

‘যখন আমাদের কাছে একটি সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে তথ্য থাকে, তখন আমরা আমেরিকান কর্মীদের (দূতাবাস কর্মী) তা সরবরাহ করি।’

আইএসের কয়েকজন সদস্যের তালিকা করেছে সাউথ আফ্রিকা। কোয়াজুলু-নাটালে দুই ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদকে হত্যার দায়ে এক দম্পতিসহ তিনজনের বিচার চলছে। হত্যার পর দুই ব্রিটিশ নাগরিকের মরদেহ খুনিরা কুমিরের মুখে ফেলে দিয়েছিল। এ ছাড়া বোমা হামলার পরিকল্পনা এবং আইএসে যোগ দেয়ার অভিযোগে দুইজনকে জেলে ঢুকিয়েছে সাউথ আফ্রিকা সরকার।

ওপারম্যান বলেন, ‘অক্টোবরের নাটক সত্ত্বেও সাউথ আফ্রিকা আপাতত আইএস থেকে কিছুটা নিরাপদ। তারপরও হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সতর্কতা না পেলে কর্তৃপক্ষ হয়তো বিষয়টি ধরতেই পারবে না।’

এ বিভাগের আরো খবর