মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিম জানিয়েছিলেন, অতীতের দিকে তিনি তাকাবেন না। এমন একটি মন্ত্রিসভা নিয়ে এগিয়ে যাবেন যেখানে তার রাজনৈতিক বিরোধীরাও থাকবে। ছোট মন্ত্রিসভা নিয়ে জনগণের সেবা করতে চান তিনি।
মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচন হয় গত শনিবার। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জোটের কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোট সর্বোচ্চ ৮২টি আসনে জয় পায়। আর মুহিউদ্দিন ইয়াসিন নেতৃত্বাধীন মালয়–মুসলিম পেরিকাতান ন্যাসিওনাল (পিএন) পায় ৭৩টি আসন। কোনো জোটই ২২২ আসনের পার্লামেন্টে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ১১২ আসন পায়নি।
অন্যদিকে তৎকালীন মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাসিওনাল ৩০ আসন পেয়েছে। তবে তারা কোনো জোটকে সমর্থন দেয়নি। এতেই বিপত্তি বাধে।
শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের দায়িত্ব পড়ে রাজার ওপর। তিনি রাজনীতিকদের কাছে জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ নিয়ে রাজা সরকারপ্রধানদের পরামর্শও নেন। এতসবেও সুরাহা মেলেনি। শেষমেশ বৃহস্পতিবার ‘কাউন্সিল অব সুলতানস’-এ বৈঠক করেন রাজা। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় সরকার গঠন করবেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করে আসছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। শেষ পর্যন্ত তার সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। এ সময়ে তাকে দু’বার জেলে ঢুকতে হয়েছে।
মালয়েশিয়ার পেনাং দ্বীপে ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্ম। ছাত্রজীবনে কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন মুসলিম যুব দলের কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। গ্রামীণ দারিদ্র্য ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ায় ছাত্র অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি।
এর বেশ কয়েক বছর পর তৎকালীন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের দল ইউনাইডেট মালয়েস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন আনোয়ার। প্রবেশ করেন মূলধারার রাজনীতিতে।
এক সময় মাহাথির মোহাম্মদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছনে আনোয়ার। কারণেই তাকে মাহাথিরের উত্তরসূরি ভাবা হতো। তবে ১৯৯৮ সালে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেন মাহাথির। অভিযোগ দুর্নীতি ও সমকামিতা। এ নিয়ে মামলা হয়।
সমকামিতার দায়ে ১৯৯৯ সালে ইব্রাহিমকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরের বছর দুর্নীতির অভিযোগে আরও ৯ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি।
শুরু থেকেই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন আনোয়ার। দাবি করেন মাহাথিরের ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করলে ২০০৪ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমকে মুক্তি দেয় আদালত।
ছাড়া পেয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেও, ২০০৮ সালের নির্বাচনে খুব বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি। ২০১২ ও ২০১৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনেও আশানুরূপ ফল আসেনি। ২০১৫ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমকে আবারো সমকামিতার অভিযোগে জেলে ঢোকানো হয়।
মাহাথিরের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাকাতান হারাপান জোট পায়। এই জোটের অংশ ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমের দল ‘পিপলস জাস্টিস পার্টি’। ভোটের পর রাজার নির্দেশে মুক্তি দেয়া হয় তাকে।
এবার নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন মাহাথির মোহাম্মদ। ক্ষমতা পোক্ত করার পর আনোয়ার ইব্রাহিমকে পূর্ণ ক্ষমা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। জানান, দুই বছরের মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাহাথিরের অপ্রত্যাশিত অবসরের পর ভেঙে পড়ে পাকাতান হারাপান জোট। রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে মালয়েশিয়া।
জোট সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসে ইউএমএনও। মুহিউদ্দিন ইয়াসিন নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেও এক বছরের মাথায় পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে তিনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন প্রধানমন্ত্রী হন ইউএমএনওর ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব।
সবশেষ চলতি বছরের অক্টোবরে আগাম নির্বাচনের ডাক দেন ইয়াকুব। ভোটে পাকাতান হারাপান জোট সবচেয়ে বেশি আসন পায়। আর এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন আনোয়ার ইব্রাহিম।