নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে ইরানে চলা বিক্ষোভে সংহতি জানানোর মূল্য জীবন দিয়ে মেটাতে যাচ্ছেন দেশটির সঙ্গীতশিল্পী ও আলোচিত র্যাপার সামান ইয়াসিন। তিন সপ্তাহে আগে নিজ বাড়িতে থেকে টেনে-হিঁচড়ে ইয়াসিনকা তুলে নিয়ে গিয়েছিল ইরানের পুলিশ। তরুণ এই কুর্দি শিল্পীর বিরুদ্ধে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর (মোহারাবেহ) অভিযোগ আনা হয়েছে; যার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
ইয়াসিনের ভাগ্য কদিনের মধ্যেই নির্ধারণ হবে ইরানের আদালতে। চলমান বিক্ষোভে সমর্থনের জন্য ইয়াসিনের মতো হাজার হাজার তরুণ-তরুণী জেলে বন্দী।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আশঙ্কা, তরুণদের বার্তা দিতে বিচারে ‘কঠোর দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করতে পারে ইরানের শাসকগোষ্ঠী।
জাতিসংঘের হিসাবে, হিজাব ইস্যুতে ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে শিশুসহ আনুমানিক ১৪ হাজার মানুষকে সরকার আটক করেছে।
ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি জাভেদ রেহমান বলেন, ‘গত ছয় সপ্তাহে পুরুষ, নারী এবং শিশু মিলিয়ে ১৪ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের কর্মী।
‘নতুন উদ্বেগের খবর হলো- সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে তেহরানে গ্রেপ্তার ১ হাজারের বেশি ইরানির পাশাপাশি শহরের আশপাশ থেকে গ্রেপ্তার প্রায় একই সংখ্যক বিক্ষোভকারীর প্রকাশ্যে বিচার হবে। এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে কয়েকটির সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর এই বিচারে জবাবদিহির সুযোগ কম। ইরানে এমন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমি জোর আহ্বান জানাচ্ছি।’
ইরানে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যে শক্ত ব্যবস্থা নেবে ইরান সরকার, তা আগেই ধারণা করা হচ্ছিল। কারণ বিক্ষোভটি চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরানে চলা ইসলামিক শাসন ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলছে। যে কয়েকটি ভিত্তির ওপর এই শাসন ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে, হিজাব তার অন্যতম স্তম্ভ।
২২৭ জন ইরানি আইনপ্রণেতা গত ৬ নভেম্বর বিচার বিভাগের কাছে একটি আর্জি জানান। তারা বিক্ষোভকারী, তাদের সহায়তা প্রদানকারী এবং ‘দাঙ্গায়’ উসকানিদাতাদেরকঠিন সাজার আবেদন করেছিলেন। মানবাধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় আসতে পারে বিচারে।
নরওয়েভিত্তিক কুর্দি অধিকার গোষ্ঠী হেনগাও বলছে, প্রতিবাদকারীদের ভয় দেখাতে ইয়াসিনের মতো হাই-প্রোফাইল বন্দিদের ব্যবহার করতে পারে ইরানের সরকার।
উদীয়মান শিল্পী ইয়াসিন ইরানে সুপরিচিত এবং প্রশংসিত। ইসলামিক শাসনব্যবস্থার ঘোর সমালোচক তিনি। বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বার্তা ও কয়েকটি প্রতিবাদী গান লিখেছেন ইয়াসিন।
হেনগাওয়ের কর্মকর্তা সোমা রোস্তামি বলেন, ‘আমরা জানি সরকার সহজেই মানুষকে হত্যা করে এবং বন্দীদের সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দেয়। সামান ইয়াসিন গুরুতর বিপদে। আমাদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো।’
অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইয়াসিনের পরিবারকে ভয় দেখিয়েছে সরকার। চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইয়াসিনের বিরুদ্ধে ‘মোহারাবেহ’ (ঈশ্বরের বিরুদ্ধে শত্রুতা) অভিযোগ গঠনের পরও তারা সাড়াশব্দ করেনি।
ইয়াসিনের মাথার ওপর যখন ফাঁসির দড়ি ঝুলছে, তখন কারাগারে ভালো নেই বিক্ষোভে আটক বন্দীরা। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, জেলে তাদের বেধক পেটানো হচ্ছে।
ইয়াসিনের মতো বন্দী আছেন ৩২ বছরের সংগীতশিল্পী এবং র্যাপার তোমাজ সালেহি। ৩০ সেপ্টেম্বর দুই বন্ধুর সঙ্গে গ্রেপ্তার হন তোমাজ।
তোমাজের পরিবারের দাবি, বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে গান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগানসম্বলিত ছবি পোস্ট করার অপরাধে পুলিশ তাকে ‘ভয়ংকরভাবে’ পিটিয়েছে।
জনপ্রিয় শিল্পীর মুক্তির দাবিতে অনলাইনে তার সমর্থকরা ব্যাপকভাবে হ্যাশট্যাগ #ফ্রিটুমাজ শেয়ার করছে।
সুপরিচিত ইরানি র্যাপার তোমাজ সালেহির গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বার্লিনের ব্র্যান্ডেনবার্গ গেটে একটি বিক্ষোভ। ছবি: সংগৃহীত
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তোমাজের এক বন্ধু বলেন, ‘আমরা যখন তার গ্রেপ্তারের কথা শুনলাম, তখন বিধ্বস্ত হয়েছিলাম, তবে ভেঙে পড়িনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যা যা করতে পারি তার সবই করছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে ইসলামিক রিপাবলিককে। আর এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে কারাগারে বন্দী ও নির্যাতনের শিকার ইরানিদের মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ তারা ভুল কিছু করেনি, কেবল স্বাধীনতা চেয়েছে।’
‘আমরা জানি, আমাদের আরও শক্ত আঘাত করতে চায় সরকার। তারা আমাদের মধ্যে ভয় জাগিয়ে তুলতে চায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সমালোচক এবং নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের গ্রেপ্তার করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের শাসকরা নিজেরাই নিজেদের তৈরি আইনের লঙ্ঘন করছে।
‘নিজের পরিবারের পক্ষে আদালতে আসা আইনজীবীরাও গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে আছেন।’
মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনা প্রথম প্রকাশ করা দুই ইরানি নারী সাংবাদিককে গত সপ্তাহে ‘আমেরিকার গুপ্তচর’ অ্যাখ্যা দেয় ইরানি কর্তৃপক্ষ। এটি এমন একটি অভিযোগ যার সাজা মৃত্যুদণ্ড।