পাকিস্তানের ধ্বংস ঠেকাতে সেনাবাহিনী প্রধান (সিওএএস) জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইসলাম (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান। হত্যাচেষ্টার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় লাহোরের শওকত খানুম হাসপাতাল থেকে দেয়া প্রথম ভাষণে এ আহ্বান জানান ইমরান।
তিনি বলেন, ‘আপনি (সিওএএস) যদি কুলাঙ্গারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন তবে জাতি ভেঙে পড়তে শুরু করবে।’
পিটিআই প্রধান ইমরান খান দাবি করেন, সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানকে কেবল তার দল পিটিআই ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে।
ইমরান বলেন, ‘সামরিক বাহিনী যদি দেশকে একত্রিত করতে পারত, তবে পূর্ব পাকিস্তান ভেঙে যেত না। শুধু রাজনৈতিক দলগুলো দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে, সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করে। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি।’
পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরাবাদে আগাম নির্বাচনের দাবিতে আয়োজিত ইসলামাবাদ অভিমুখী লং মার্চে বৃহস্পতিবার ইমরান খানের ওপর বন্দুক হামলা হয়। তার পায়ে গুলি লাগলেও, তা অপসারণ করা হয়েছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। ভর্তি আছেন লাহোরের শওকত খানুম হাসপাতালে।
- আরও পড়ুন: দলের কর্মীরাই বাঁচালেন ইমরানের প্রাণ
হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে আগেই জানতেন বলে দাবি করে ভাষণে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘হামলার আগের দিন জানতে পারি গুজরাটের ওয়াজিরাবাদে তারা আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।’
ওই ঘটনার পেছনে যে তিনজনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন, তাদের পদত্যাগ দাবি করেন ইমরান।
তিনি বলেন, ‘একটি জাতি ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত স্বাধীন হয় না। হামলায় জড়িত তিন জনেরই পদত্যাগ করা উচিত। অন্যথায়, তদন্ত এগুবে না।’
এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়ালকে উদ্দেশ্য করে ইমরান বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নেতা ‘ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না’। গত ছয় মাসে আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা কখনও শত্রুর সঙ্গে কোনো রাষ্ট্র করেনি।
‘আমি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার জিতেছি। ক্রিকেটে পাকিস্তানের সম্মান বাড়িয়েছি। শওকত খানম হাসপাতাল আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় করেছি। তারপর দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল গঠন করেছি।’
অতীতের সরকারের ওপর বিরক্ত হওয়ার কারণেই জনগণ পিটিআইকে ভোট দিয়েছে বলে দাবি করেন ইমরান খান। পিএমএল-এন এবং পিপিপিকে কটাক্ষ করে ইমরান বলেন, ‘দুই দল ব্যাপক দুর্নীতি করে দেশের ঋণ বাড়িয়েছে।’
‘জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে কারণ তারা ওদের ওপর বিরক্ত ছিল। কিন্তু কমিশন এখন বলছে, পরিবর্তনের সময় এসেছে। তাদের ফিরিয়ে আনা হবে।’
গত ছয় মাসের ঘটনা স্মরণ করে ইমরান বলেন, ‘কোনো সরকারই আস্থা ভোটে পরাজিত হয় না। কারণ সরকারের কাছে অর্থ থাকে।
‘এমনটা হয়েছে কারণ আমেরিকার কূটনীতিক ডোনাল্ড লু আমাদের রাষ্ট্রদূতকে হুমকি দিয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, ইমরান খানকে সরিয়ে না দিলে পাকিস্তান সমস্যায় পড়বে। তারপর অর্থের বিনিময়ে আমাদের আইনপ্রণেতাদের আনুগত্য কিনে নেয়া হয়।
‘ক্ষমতাসীন পিটিআই এসব দর কষাকষিতে না জড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ এটার অর্থ জাতি এবং জনগণের অর্থ চুরি করা। তারপর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন ইমরান শেষ হয়ে গেছে, আর ফিরতে পারবে না। তবে পাকিস্তানিরা এমন এক জাতি, যারা অসম্ভবকে সম্ভব করে।’
- আরও পড়ুন: ইমরানের লং মার্চ, ইসলামাবাদে রণসাজ
পিপিপি এবং পিএমএল-এনের মতো নিজের দল কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি হয়নি জানিয়েছে ইমরান দাবি করেন, জনগণের সমর্থনে তার দল ক্ষমতায় এসেছিল।
পিটিআই প্রধান বলেন, ‘জনগণ যেভাবে আমাকে সমর্থন করেছিল, আমি অবাক হয়েছিলাম। আমরা ২৫ মে লং মার্চ ঘোষণা করি। আমার মেয়াদে তারা তিনটি লং মার্চ করেছে। এটা করতে পেরেছে কারণ আমরা আইন ও সংবিধানে বিশ্বাস করি।
‘আমরা ভেবেছিলাম তারা আমাদের অনুমতি দেবে। কারণ আমরা তাদের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এর পরিবর্তে আমাদের নেতাকর্মীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে।’
সরকারি সংস্থাগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ইমরান। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ে উপনির্বাচনের সময় সবগুলো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার হয়েছিল, ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল। তারপরও পিটিআই নির্বাচনে জয়লাভ করে।
‘এরপর শুরু হয় হুমকি-ধমকি। ইসলামাবাদ থেকে মেজর জেনারেল ফরসাল নামে একজন এসেছিলেন। পিটিআইকে কীভাবে সোজা করা যায়, সেটি তিনি দেখবেন বলে শাসান।
‘পিটিআইপন্থী মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ হয়। আমাকে ছেড়ে যেতে এমপিদের ভয় দেখানো হয়। তাদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়।’
তোশাখানা রেফারেন্সে অযোগ্য ঘোষণা করতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে (ইসিপি) ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইমরান খান। তিনি বলেন, ‘তোশাখানার পুরো রেকর্ড তোশাখানার কাছে আছে। এখানে চুরির কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমাকে অযোগ্য করে দিয়েছে। তারা আমাকে এমন একজনের সঙ্গে তুলনা করছে, যার বিদেশে কোটি কোটি টাকার সম্পদ আছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজাকে ‘শরিফ পরিবারের সেবক’ দাবি করে ইমরান বলেন, ‘ইসিপির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা আদালতে যাব।’
- আরও পড়ুন: ভোটের মাঠে জনপ্রিয় ইমরানের ভবিষ্যৎ কী
২৩ অক্টোবর কেনিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন পাকিস্তানের অনুসন্ধানী সাংবাদিক আরশাদ শরীফ। তার প্রসঙ্গ টেনে ইমরান বলেন, ‘আরশাদ শরীফের সঙ্গে যা হয়েছে, জাতি কখনই তা ভুলবে না।
‘সাংবাদিকরা এবং আরশাদের পরিবার জানে কেন তাকে দুবাই আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কারণ তাকে কেনা যায়নি, ভয় দেখিয়েও কাজ হয়নি। তার শাহাদাৎ পাকিস্তানের অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা।’
পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান দাবি করেছেন, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল চারজন।
তিনি বলেন, ‘আমি একটি ভিডিও তৈরি করেছি। সেখানে তাদের নাম দিয়েছি। ভিডিওটি বিদেশে লুকিয়ে রেখেছি, কিছু হলে এটি প্রকাশ করা হবে। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই চক্রান্তের তথ্য পেয়েছিলাম।’
ভাষণের শেষে পিটিআই প্রধান ইমরান খান সুস্থ হয়ে ফের রাস্তায় নামার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, ‘সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইসলামাবাদমুখী লং মার্চের ডাক দেব। আপনারা স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করবেন না। কারণ ক্রীতদাস জাতিকে বিশ্বে সম্মান দেয়া হয় না। তারা কখনো উন্নতি করতে পারে না।’