ইরানে হিজাব ইস্যুতে চলমান বিক্ষোভ মোকাবিলায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং বার্লিনের রাস্তায় শনিবার বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার মানুষ। তারা ইরানে বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়াদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছেন।
কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন ২২ বছরের মাহসা, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। সেদিন হাসপাতালের সামনে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইরানে।
ওয়াশিংটনের ইউএস ন্যাশনাল মলে বিভিন্ন বয়সী কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ইরানের পতাকার আদলে পোশাক পরে বিক্ষোভ করেছেন। হোয়াইট হাউসের দিকে যাওয়ার সময় তাদের চিৎকার করে বলতে শোনা, ‘ভয় পাও...ভয় পাও, এখানেই আমরা এক’... ‘তার নাম বল! মাহসা!’
যুক্তরাষ্ট্রের তৃণমূল সংগঠকরা এই বিক্ষোভের আয়োজন করে। কর্মসূচিটি ওয়াশিংটনে থাকা ইরানিদের ব্যাপক আকৃষ্ট করে। প্রতিবেশী কানাডার টরন্টো থেকেও অনেকে বিক্ষোভে অংশ নেন।
ইরানের পর লস অ্যাঞ্জেলেসে সবচেয়ে বেশি ইরানি বাস করেন। বিক্ষোভকারীদের একটি দল শহরের একটি রাস্তা আটকে প্রতিবাদ জানায়। এ সময় শত শত মানুষ পতাকা হাতে ইরান সরকারের পতনের দাবিতে স্লোগান দেন।
তারা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমরা স্বাধীনতা চাই’।
শুকা শারমের বাবা-মা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের সময়। যুক্তরাষ্ট্রেই তার জন্ম। ইংরেজি এবং ফারসিতে লেখা ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগান-সংবলিত একটি টি-শার্ট পরে বিক্ষোভে আসেন শুকা।
তিনি বলেন, ‘ইরানে নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো, তারা এতে অসুস্থ পড়ছে।’
১৬ সেপ্টেম্বর আমিনির মৃত্যুর পর ইরানজুড়ে চলা সরকারবিরোধী বিক্ষোভের অন্যতম অ্যাজেন্ডা নারীর পোশাকের স্বাধীনতা। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক হিজাব করার বিষয়টি আর মানতে পারছেন না ইরানের নারীরা। বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০৯ সালের গ্রিন মুভমেন্টের পর, এবারের বিক্ষোভটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। শনিবার তেহরানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি গুলি এবং কাঁদানে গ্যাস দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, বিক্ষোভে কিশোরীসহ ২০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
ইরানের নাগরিকদের বিরুদ্ধে বর্বরতা ও দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়েছে আমেরিকা সরকার। সতর্ক করে বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, সহিংসতা অব্যাহত থাকলে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা চিন্তা করবে তারা।
লস অ্যাঞ্জেলেসে ইরানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় বিক্ষোভকারীরা মাহসা আমিনির একটি বিশাল ছবি বহন করে
ওয়াশিংটনে বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠে শনিবার ছিল ‘জীবন এবং স্বাধীনতা’ নিয়ে ঐতিহ্যবাহী ফারসি গান। এসব গানগুলো লেখা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের পর। ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ইরানি সংগীতশিল্পী শেরভিন হাজিপুরের ‘বারায়ে’ গানটি বেশ নজর কেড়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ইনস্টাগ্রামে গানটি পোস্ট করার পরপরই গ্রেপ্তার হন ২৫ বছরের শেরভিন। গানটি ৪০ মিলিয়নেরও বেশি দেখা হয়েছে; এটি এখন ইরান বিক্ষোভের অনানুষ্ঠানিক গান হয়ে উঠেছে।
বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল, ‘নারীর জন্য, জীবন, স্বাধীনতা,’... ‘আজাদি-স্বাধীনতা।’
ইরানের চলা বিক্ষোভ ইতোমধ্যে গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। বিক্ষোভে অংশ নেয়াদের একজন সামিন আয়ানিফার্ড। মিশিগান থেকে গাড়ি চালিয়ে ওয়াশিংটন আসেন ২৮ বছরের সামিন। তিন বছর আগে ইরান সামিন বলেন, ‘ ইরান ও আমেরিকায় আমাদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলে এটা নারীর শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার মতো ঘটনা।’
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে ইরানি বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়েন কয়েক হাজার মানুষ। কর্মসূচিটি ওমেন (স্টারিস্ক) লাইফ ফ্রিডম কালেক্টিভ নামে একটি সংগঠন আয়োজন করে। শহরের টিয়ারগার্টেন পার্কের ভিক্টোরি কলামে শুরু হয়ে মধ্য বার্লিন প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ মিছিলটি।
বিক্ষোভ মিছিল থেকে অনেকে জানান, ইরানি প্রতিবাদকারীদের সমর্থন জানাতে তারা জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন।
ইরানের নাগরিক সাকিব লোলো নেদারল্যান্ডসে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এখানে উপস্থিত হওয়া আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদের কণ্ঠস্বর হতে চাই, যারা ইরানের রাস্তায় প্রাণ দিয়েছেন।
‘এটি এখন আর কোনো প্রতিবাদ নয়, এটা বিপ্লব। বিশ্বকে তা এড়িয়ে গেলে চলবে না।’