ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মল্লিকার্জুন খারগে। ৮০ বছরের খারগে কংগ্রেসের নেতৃত্ব প্রশ্নে ভোটে ক্যারিশম্যাটিক সংসদ সদস্য শশী থারুকে আট গুণ বেশি ভোটে হারিয়েছেন।
নতুন প্রধানকে বুধবার অভিনন্দন জানিয়ে শশী থারু বলেছেন, ‘কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন আজ সত্যি সত্যিই শুরু হয়েছে। এটা আমি বিশ্বাস করি।’
২০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম পার্টির নেতৃত্বে এমন একজন এসেছেন যিনি গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ। শেষবার গান্ধী পরিবারের বাইরে কংগ্রেসের দায়িত্ব সামলেছেন সীতারাম কেশরী। তবে তিনি তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। দায়িত্ব নেয়ার দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে অনাকাঙ্খিতভাবে তাকে অপসারণ করা হয়েছিল।
মল্লিকার্জুন খারগে সোনিয়া গান্ধীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া ১৯ বছর ধরে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজীব-সোনিয়ার ছেলে রাহুল গান্ধী ২০১৭ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলের ভরাডুবির দায় নিয়ে দুই বছর পর তিনি পদত্যাগ করেন। তারপর থেকে মা সোনিয়া গান্ধী অন্তর্বর্তী প্রধান হিসেবে দল সামলেছেন।
গান্ধী পরিবারের অনুগত খারগে যে দলের নেতৃত্বে আস্তে যাচ্ছেন তার আভাস আগেই মিলেছিল। তাই এই জয়কে প্রত্যাশিতই বলা যায়। সাবেক ফেডারেল মন্ত্রী খারগে দলে সাংগঠনিক সংস্কার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
খারগের হাতে এমন এক সময়ে দলের বৈঠা এলো, যখন ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি অস্তিত্ব সংকটের মুখে রয়েছে। তার উপর দরজায় কড়া নাড়ছে জাতীয় নির্বাচন। প্রস্তুতি নিতে ১৮ মাসের কম সময় পাচ্ছেন খারগে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উড়তে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) চ্যালেঞ্জ জানাতে কংগ্রেসে বড় ধরনের সংস্কার সময়ের দাবি।
কে এই খারগে?
দক্ষিণ রাজ্য কর্ণাটকের দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য খারগের রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ।
মল্লিকার্জুন খারগের জন্ম ১৯৪২ সালে বিদার জেলায়। পাশের জেলা গুলবার্গায় তিনি বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেছেন আইন বিভাগে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন শ্রমিক সংগঠনগুলোর। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালে যোগ দেন ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টিতে।
গান্ধী পরিবারের অনুগত হিসেবে পরিচিত খারগে
তরুণ খারগের মধ্যে দারুণ কিছু দেখতে পেয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস প্রধান দেবরাজ উরস। উচ্চ বর্ণ-অধ্যুষিত গুরমিতকাল আসন থেকে ১৯৭২ সালে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করান দেবরাজ। আশাহত করেনি খারগে। টানা ৯বার সেই আসন থেকে জিতেছিলেন তিনি। পরে চিতাপুর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেখানেও বাজিমাত করেন খারগে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইন্দুধরা হোন্নাপুরা বলেন, ‘তিনি একজন দলিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গেও অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ছিলেন।’
একজন চৌকস প্রশাসক খরগে বিভিন্ন রাজ্য সরকারে মন্ত্রী পদে কাজ করেছেন।
অবসরপ্রাপ্ত একজন আমলা বলেন, ‘খারগে সবসময় সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি নম্র ছিলেন। যদিও তার নিজস্ব একটা জগত আছে। সেখানে তার অবস্থান স্পষ্ট ছিল।’
ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্র দিল্লিতে খারগের আগমন ঘটে ২০০৯ সালে। সেবার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা নির্বাচনে গুলবার্গা আসন থেকে জয় পান তিনি। এই আসন থেকে ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদেও জয় পান খারগে। তবে ২০১৯ সালে বিজেপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি। ২০২১ সালে তিনি উচ্চকক্ষে নির্বাচিত হন।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ খারগে পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। রেলওয়ে এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেখভালকারী ফেডারেল সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে বর্তমান কার্যভারটি খারগের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি এবং পার্টির সভাপতি অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপির অভূতপূর্ব উত্থানের বিপরীতে কংগ্রেস পার্টির অবস্থা হয়েছে শোচনীয়।
২০১৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস কেবল ৫৩ আসনে জয় পেয়েছিল। যেখানে ৫৪৫ সদস্যের পার্লামেন্টের ৩০৩টি গিয়েছিল বিজেপির পক্ষে।
কংগ্রেস তার সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলোতেও ক্ষমতা হারিয়েছে। এখন কেবল দুই রাজ্য শাসন করছে ন্যাশনাল কংগ্রেস।
খারগে কি পারবেন বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিজেপিকে মোকাবিলা করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন নতুন কংগ্রেস প্রধান। শুরুতেই তাকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি কেবল গান্ধী পরিবারের একজন প্রক্সি নন; দলের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই।
সোমবার ভোট চলাকালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি জানান, সব সিদ্ধান্ত তিনি নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারবেন না। তবে তাদের নির্দেশনা এবং পরামর্শ চাইবেন। কারণ গান্ধীদের দল পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আছে।
অভ্যন্তরীণ বিবাদ মেটানো খারগের দ্বিতীয় শক্ত চ্যালেঞ্জ। দলীয় কোন্দলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা দল ছেড়েছেন। দলে থাকলেও অনেকে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আসছেন।
দলীয় প্রধানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন শশী থারু
রাজনৈতিক ভাষ্যকার কে বেনেডিক্ট বলেন, ‘খারগে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা কমাতে যথেষ্ট দক্ষ। কারণ তিনি দলেরই একজন। তাকে শ্রদ্ধা করে দলের লোকজন।’
তবে কেউ কেউ বলছেন, দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিক হয়ে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মতো উত্তরের রাজ্যগুলোতে খুব বেশি আবেদন তৈরি করতে পারবেন না খারগে। ১২০ আসনের এই দুই রাজ্যে কংগ্রেসের অবস্থা ভীষণ নড়বড়ে।
ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক পূর্ণিমা যোশী অবশ্য বলছেন, জাতীয়ভাবে দলকে নতুন করে এগিয়ে নেয়ার মতো সক্ষমতা নেই নতুন কংগ্রেস প্রধানের।
‘তিনি একজন শালীন মানুষ, শিকড়যুক্ত একজন রাজনীতিবিদ। কেউ তাকে হালকাভাবে নিতে পারবে না। তবে কংগ্রেসের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে, মানে দলের মধ্যে যে শূন্যতা রয়েছে তা পুরোপুরি পূরণ করতে পারবেন না খারগে।
‘মোদি-শাহ জোটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তিনি সক্ষম হবেন, এমন সম্ভাবনা কম। কংগ্রেসের এমন একজন দরকার যে তাদের (মোদি-অমিত) ভাষা বুঝতে পারে। এমন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি যিনি নানা কৌশলে বিজেপিকে পরাজিত করতে পারবে। তবে বিজেপির সঙ্গে আদর্শিকভাবে লড়াই করতে পারবেন খারগে। যেটা দেখে জনগণ হয়ত তাকে বেছে নিতে পারে।’