ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় চলমান বিক্ষোভ পঞ্চম সপ্তাহে গড়িয়েছে। এদিকে বিক্ষোভ দমনে সরকারের পদক্ষেপ কী হতে পারে তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশটির আইনপ্রনেতারা। অনেকেই বিক্ষোভরত নারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলছেন।
বিক্ষোভ এরই মধ্যে পোশাকের স্বাধীনতার ইস্যুকে ছাড়িয়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষও হচ্ছে।
অনেক আইনপ্রণেতাই হিজাবের পক্ষে কঠোর পন্থা অবলম্বনের প্রতি জোর দিয়েছে এবং বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমনের আহ্বান জানিয়েছে। তবে অনেক আইনজীবীই চাইছেন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মেনে নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার উপায় খুঁজতে।
ইরানের আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা মোজতাবা জোলনৌরি বলেন, ‘যে নারীরা তাদের চুল ঢেকে রাখে না তাদের ৭৪টি বেত্রাঘাতের শাস্তি হওয়া উচিত। যেসব নারী তাদের হিজাব খুলে ফেলে, তাদের জন্য নৈতিকতা পুলিশের একটি নোটিশ যথেষ্ট না।’
পাশাপাশি যেসব আইনপ্রণেতা নৈতিকতা পুলিশকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাদেরও সমালোচনা করেছেন মোজতাবা জোলনৌরি।
তিনি বলেন, ইরানিদের তার মিশনের (নৈতিকতা পুলিশের) পেছনে যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। তিনি অভিযোগ করেন যে আইনপ্রণেতারা নৈতিকতা পুলিশের সমালোচনা করছেন, তারা জনসাধারণের মানসিক শান্তি নষ্ট করছেন।
জোলনৌরি ইরানের সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য।
ইরানের আইনপ্রণেতা ও রক্ষনশীল ধর্মীয় নেতা মোজতাবা জোলনৌরি
আরেক কট্টরপন্থি আইনপ্রণেতা মুসা গাজানফরাবাদি বলেছেন, যে নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাব নিয়ম লঙ্ঘন করে তাদের মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিহ্নিত করা উচিত এবং পরবর্তীতে সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত।
এদিকে ইরানের পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতা হোসেন নুশাবাদি মনে করেন, সরকারের এমন কিছু স্থান ঠিক করে দেয়া উচিত যেখানে বিক্ষোভকারীরা দমন-পীড়নের ভয় ছড়াই শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পারে।
তিনি দাবি করেন, গত ৩০ বছরে বারবার এই আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এদিকে আইনপ্রণেতা হাসান আসফারির অবস্থান পুরোপুরি বিক্ষোভকারীদের প্রতি। আইএলএনএকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বিক্ষোভ সমাবেশ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতির প্রয়োজন নেই। মজলেসে (পার্লামেন্ট) নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্ব্যবহারের জন্য কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে প্রস্তাব পেশ করছি।’
প্রতিবাদ করার অধিকার ইরানের সংবিধানের ২৭তম অনুচ্ছেদে স্বীকৃত। কিন্তু গত চার দশকে ইরানের বিভিন্ন সরকার এই অধিকারকে সমর্থন এবং সাংবিধানিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে অস্বীকার করেছে।
তবে প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য আইনে নির্ধারিত একমাত্র শর্ত হল বিক্ষোভকারীদের সশস্ত্র হওয়া উচিত নয় এবং প্রতিবাদ ইসলামের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত নয়।
আসাফারির মতে, ইরানে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন না হলে জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকার সম্পর্কে সরকারকে বোঝানো কঠিন।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর সঙ্গে এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে বালুচ কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনা ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের চাবাহার শহরের পুলিশপ্রধানের হাতে ওই কিশোরী ধর্ষণের প্রতিবাদ জানাতে সেখানেও চলছে প্রবল বিক্ষোভ।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
একেবারে শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করছেন ইরানি নারীরা।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।