পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ইরানে। দিনে দিনে জোরাল হচ্ছে বিক্ষোভ। রাজধানী তেহরানসহ দেশের নানা অঞ্চলে প্রায় মাসব্যাপী আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন নারী-শিশুসহ অন্তত ১৮৫ জন।
ইরান বিক্ষোভের পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়েন। সংবাদমাধ্যমটির ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর প্যাট্রিক উইন্টুরের লেখা নিবন্ধটি অবলম্বনে বিশ্লেষণ তুলো ধরা হলো নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালে জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান গত মাসে। তিনি যখন নিউ ইয়র্কের মিলেনিয়াম হিল্টন হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন নিজ দেশে পুলিশি হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদের বিক্ষোভ ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে রাইসির এই সাক্ষাতের শুরুতে ১০ মিনিটে একটা শর্ট ফিল্ম দেখানো হয়। তাতে ছিল দেশভ্রমণ ও ইরানিরা কীভাবে ‘নতুন ধারার গণতান্ত্রিক শাসনে সুখে-শান্তিতে বাস করছে’ সে বিষয়ক গুণগান। ইরানে ওই মুহূর্তে যা ঘটছিল সেটার পরিপ্রেক্ষিতে এই ভিডিওটি অযৌক্তিক প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। একইসঙ্গে এটি প্রমাণ করে, দেশটির শাসকদল কতটা ভ্রান্তিতে ভুগছে।
রাইসির প্রতিনিধিরা বিক্ষোভের বিষয়ে প্রশ্ন শুনতে শুরুতে রাজি হননি। এরপর রাইসি শুনতে রাজি হলেও তিনি পশ্চিমা দ্বিমুখী নীতি সম্পর্কে তীব্র সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন। অনেক জোরে কথা বলা শুরু করায় হেডফোনের মাধ্যমে মৃদু স্বভাবের অনুবাদকের কথাগুলো বোঝা কঠিন হয়ে যায়।
রাইসি বলেন, আমিনির মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে চূড়ান্ত কিছু জানা যায়নি। তবে প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে তার স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। পাশাপাশি তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ছয় মাসে যুক্তরাজ্যে ৮১ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে প্রতিদিন কতজন পুরুষ ও নারী নিহত হন?’
বিক্ষোভের দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পর পরিষ্কার যে, ইরানে কতটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সে সম্বন্ধে রাইসির খুব বেশি ধারণা নেই। গণগ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পরেও বিক্ষোভ শেষের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এটাও পরিষ্কার নয়, ইরানের পুরনো নেতৃত্ব নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন মনে করছে কিনা, যে কারণে তাদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের শুভেচ্ছাদূত ও বৃটিশ-ইরানিয়ান অভিনেতা নাজানিন বোনিয়াদি মনে করেন, ইরানের রাজপথে নতুন কিছুর উত্থান ঘটেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার নিয়ে ১৪ বছর ধরে কাজ করছি। এ দীর্ঘ সময়ে আমি ইরানের শাসকদের বিপক্ষে এমন অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। অবশ্য ইরান প্রতি দশকেই এমন ব্যাপক বিক্ষোভে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর পরেও ১৯৯৯ সালের ছাত্র বিক্ষোভ বা ২০০৯ সালের গ্রিন মুভমেন্ট বা ২০১৯ এর নভেম্বরের বিক্ষোভের সঙ্গে বর্তমান বিক্ষোভের উত্তেজনা বা মাত্রার তুলনা করা যায় না।’
বিক্ষোভকারীরা যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের গাড়ি উলটে দিচ্ছে ও আয়াতুল্লাহ খোমেনির বিলবোর্ড ছিড়ে ফেলেছে- সেসব উদাহরণ সামনে আনছেন বোনিয়াদি।
তিনি যোগ করেন, “অভূতপূর্ব বিষয়টি হলো বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। আন্দোলনের যে স্লোগান ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ সেটি ইরানের ইসলামিক মত বিরুদ্ধ। দেশটি নারীবিদ্বেষী, দমনমূলক ও ইসলামের পথে আত্মত্যাগের পক্ষে নিজেদের গড়ে তুলেছে। এ প্রতিবাদ শুধু কঠোর পোশাক নীতির বিরুদ্ধে নয়, বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধিতা ইরানি নারীদের বৃহত্তর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ইনস্টিটিউট অফ গ্লোবাল চেঞ্জ-এর ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক কাসরা আরাবির মতে, ইরানের এ প্রতিবাদ এখন বিপ্লবাত্মক।
তিনি বলেন, ‘যেসব মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে তারা বলেছেন, তারা একটি বিপ্লবের মধ্যে আছেন এবং পিছু হঠবেন না। শাসক দলের পতনের শুরু এর মাধ্যমে। এটা সংস্কারের কোনো বিষয় নয়। এটা শাসক বদলের ডাক।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাটহ্যাম হাউজের সদস্য ড. সানাম ভাকিল অবশ্য এ আন্দোলন নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সতর্ক। তার মতে, এ আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি একটি বিশাল বিভাজন প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের শক্তি, গতি ও সাহসিকতা শাসক দলকে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কাছাকাছি নিয়ে গেছে। তবে তাদের এ ধরনের আন্দোলনকে দমনের জন্য একটি ছঁক বাঁধা আছে, যেটি তারা অতীতে প্রয়োগ করেছে এবং এবারও করছে।’
ভাকিলের মতে নারী ও শিশুদের মারধরের বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়ার কিছুটা বিব্রত ইরান। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়াম যা নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
বৈশ্বিক সংহতি
প্রবাসী ইরানি, ইরানের ভেতর ও বাইরের সেলিব্রিটি ও ক্রীড়া তারকাদের অন্তর্ভুক্তি বিক্ষোভকে বৈশ্বিক মাত্রা দিয়েছে। ২৫ লাখ ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার রয়েছে ইরানি পপ তারকা দোনিয়া দাদরাসানের। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী এই তারকা নৈতিকতা পুলিশ নিয়ে একাধিক পোস্ট করেছেন। অন্য অনেকের মতো তিনিও ইরানের নারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে নিজের চুল কাটার ভিডিও পোস্ট করেছেন টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সুইডিশ সদস্য ও ইরাকি বংশোদ্ভূত আবির আল-সাহলানি গত ৪ অক্টোবর বক্তব্য দেয়ার সময় কাঁচি দিয়ে নিজের চুল কেটে ফেলেন। একই কাজ করেন যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সাবেক রাজনৈতিক বন্দি নাজানিন জাগারি-র্যাটক্লিফ। এরপর একে একে চুল কাটেন অস্কারজয়ী ফরাসি অভিনেত্রী মারিয়ঁ কোতিয়াদ, জুলিয়েট বিনোশে ও শার্লট গেইনসবুর্গ।
তবে ইরানের শাসকদল, যাদের বেশিরভাগ নেতার বয়স আশির ওপরে, তারা যেন ভিন্ন কোনো জগতে বাস করেন। তাদের মতে, বাধ্যতামূলক হিজাব নারীকে বন্দি নয়, বরং মুক্তির পথ দেখায়; যা একটি বিশুদ্ধ ইসলামি সমাজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি বিচার বিভাগের সাবেক প্রধান রাইসিকে নিজ হাতে বেছে নিয়েছিলেন। রাইসির দায়িত্ব ছিল খামেনির পাঁচটি মিস্টিক পর্যায় অর্জন করা। এগুলো হলো ইসলামি বিপ্লব, ইসলামি শাসন, ইসলামি সরকার, ইসলামি সমাজ ও ইসলামি সভ্যতা।
আগস্টে ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই রাইসি ইরানের ইসলামি দণ্ডবিধির ৬৩৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সার্বজনীন স্থানে হিজাব ব্যবহারের আইন কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে তা পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেন।
ইরানে হিজাবের প্রতি সমর্থন বহু বছর ধরেই কমে আসছে। ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী এতে বিশ্বাস করেন না বা মনে করেন তাদের ‘অন্যায়ভাবে পর্দা করানো’ হয়েছে।
তবে রক্ষণশীলরা এখন ইরানের রাজনীতির প্রতিটি স্তরে আধিপত্য বিস্তার করছেন। রাইসি ‘সতীত্বের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল’ নামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এগুলো মূলত ২০০৫ সালে গৃহীত নীতির পুনরাবৃত্তি।
১১৫ পৃষ্ঠার পরিকল্পনার মূল নীতিগুলো প্রকাশ করেছে ইরানভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ইরানওয়্যার। এগুলো হলো:
- হিজাববিহীন নারীদের খুঁজে বের করে তাদের জরিমানা করা বা তাদের কাউন্সেলিংয়ে পাঠানো।
- সামাজিক এলাকাগুলোতে বাসিন্দারা কীভাবে পোশাক পরেন তা নজরদারিতে রাখতে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রদের আবাসিক ভবনে রাখা।
- অস্ত্রোপচার করতে যাওয়া নারী রোগীদের ‘উপযুক্ত পোশাক’ সরবরাহ করতে হবে হাসপাতালের কর্মীদের।
- ‘অশ্লীল পোশাক’-এর আমদানিকারক, ক্রেতা-বিক্রেতা ও ডিজাইনারকে জরিমানা করা হবে।
- সরকারি মাধ্যমে কাজ করা অভিনেত্রীদের জন্য শৃঙ্খলার নতুন নীতিমালা প্রণয়ন।
- বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরোধিতা বা একে প্রশ্ন করে কেউ অনলাইনে পোস্ট করলে কারাদণ্ড দেয়া।
আগস্টের শেষ দিকে যে সব নারী এ নিয়ম মানেন না তাদেরকে সরকারি ব্যাংক, অফিসে প্রবেশ বা গণপরিবহনে উঠতে দেয়া হয়নি। বিশেষ করে বাস ও মেট্রোতে, এমনকি উত্তর তেহরান মেট্রোপলিটনের বাইরের এলাকাতেও কুখ্যাত নৈতিকতা পুলিশের দল আরও সক্রিয় ও সহিংস হয়ে ওঠে।
তাদের টহলের জন্য নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশ কর্মকর্তারা নারীদের আটকাচ্ছে ও গাড়িতে তুলে নেয়ার পর এক ঘণ্টা ‘নতুন করে নৈতিকতা শিক্ষা’ দিচ্ছে।
মিডিয়া ক্র্যাকডাউন
এ রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হয় কুর্দি নারী মাহসা আমিনির। মাহসা আমিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খালার বাড়িতে ভ্রমণ ও কেনাকাটার জন্য পাঁচ দিনের জন্য তেহরানে এসেছিলেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল তরুণী মাহসা সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিম ইরানের সবচেয়ে বড় উর্মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান।
তেহরানে তিনি একটি মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে তালাকানি পার্কে ঢোকার পর কী ঘটেছিল তা এখনও অস্পষ্ট। মাহসা তার ভাই কিয়ারশ আমিনিসহ তিনজন নারী ও দুজন পুরুষ আত্মীয়ের সঙ্গে হাঁটার সময় পুলিশ তাদের আটকায়।
নৈতিকতা পুলিশের অন্তত পাঁচজন সদস্য দাবি করেন মাহসা ইসলামি পোশাক আইন লঙ্ঘন করেছেন। স্বজনদের বাধা উপেক্ষা করে তাকে একটি ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
চাচাতো ভাই এরফান মোর্তেজার অভিযোগ, মাহসাকে পুলিশ ভ্যানে মারধর করা হয়। কয়েকদিন পর পুলিশের প্রকাশিত একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সংশোধন কেন্দ্রে মাহসা দাঁড়িয়ে থাকার একপর্যায়ে প্রথমে একটি চেয়ারের ওপর এবং পরে মেঝেতে পড়ে যান। তার স্ট্রোক অথবা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এর প্রায় ৩০ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং কাসরা হাসপাতালে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লাগে।
মাহসা কার্যত ব্রেন ডেড ছিল। সাময়িকভাবে তার হৃৎযন্ত্র সচল করে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর তিন দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়।
এর তিন সপ্তাহ পর ইরানি কর্তৃপক্ষ মাহসার মৃত্যুর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অবশ্য এর আগেই মাহসার এক্স-রে ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছিল। সরকারি ভাষ্য অনুসারে, মাথায় আঘাতের কারণে মাহসা মারা যাননি। তার মৃত্যুর কারণ ছিল দীর্ঘমেয়াদি হৃদস্পন্দনজনিত জটিলতায়।
পরিবারের দাবি, আট বছর বয়সে মাহসার সামান্য স্নায়ু জটিলতা ধরা পড়ে, মস্তিষ্কের সম্ভাব্য টিউমার এর কারণ হতে পারে। তবে লেভোথাইরক্সিন ব্যবহারের মাধ্যমে সেটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি একজন চিকিৎসক তাদের জানান, মাহসা সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন।
গ্রেপ্তারের পর মানসিক আঘাতের ফলে মাহসার মস্তিষ্কে খিঁচুনির সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তেমনটা হলে বিষয়টি পুলিশের পক্ষে যাবে, তারা বলতে পারবে মাহসাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়নি। নৈতিকতা পুলিশ মাহসার পরিবারকে বলেছে, গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ সদস্যরা বডি ক্যামেরা পরা ছিলেন না, যে কারণে ভ্যানে কী ঘটেছিল তার কোনো ফুটেজ নেই।
ইরানি কর্মকর্তাদের প্রতি মাহসার পরিবারের আইনজীবীদের আস্থা শূন্যের কাছাকাছি। সালেহ নিখবাখত শীর্ষস্থানীয় কুর্দি সংবাদ মাধ্যম রুদাওকে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, “জিনার (মাহসার কুর্দি ডাকনাম) বিষয়ে (ইরানি) সংস্থাগুলো যে সমস্ত দাবি করছে, যেমন তার দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা ছিল সেসব মিথ্যা ও গুরুত্ব দেয়ার মতো নয়।
‘এ অঞ্চলে বন্দি হত্যা নতুন কিছু নয় বা শুধু জিনাই প্রথম এমনটি নয়। তাকে কুর্দিস্তানে হত্যা করা হলে তারা সত্যকে বিকৃত করার সুযোগ পেত। তবে এবার সেটি পারেনি।’
মাহসার বাবা এখনও শোকার্ত এবং সরকারি তদন্তে সহযোগিতা করতে রাজি নন। তিনি মাহসার মৃত্যুর কারণ পরীক্ষা করতে সরকারি প্রভাবমুক্ত নিউরোলজিস্টদের একটি তালিকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
নিরাপত্তা বাহিনী যে সমস্ত সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের অধিকাংশ মাহসার মৃত্যুর খবর প্রকাশের সঙ্গে জড়িত। এ থেকে বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষ সত্য অনুসন্ধানে উদাসীন।
সংস্কারবাদী শার্গ পত্রিকার সাংবাদিক নিলুফার হামেদির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তিনি হাসপাতাল করিডোরে মাহসার মা-বাবার ছবি তুলেছেন এবং মাহসার মৃত্যুশয্যার যে ছবিটি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে সেটিও তার তোলা।
হামেদিকে পরে তার বাড়ি থেকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। তার টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে। তার স্বামী জানান, কারাবাসের ১৩তম দিনে তিনি জেল থেকে ফোন করেন। হামেদির স্বামী টুইট করেছে, হামেদি অন্য আটজনের সঙ্গে একটি কক্ষে ভালো আছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।
ইরানের সাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। সমালোচনামূলক টুইটের জন্য বরখাস্ত বা এমনকি কারারুদ্ধ হতে হয়েছে তাদের। ‘জনমতকে ব্যাহত করা’ ও ‘সরকারবিরোধী প্রচারণা’র মতো অভিযোগ সাংবাদিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের সীমার কথা মনে করিয়ে দেয়।
হামেদিকে হয়ত পুলিশ বাহিনী আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রেখেছিল। কারণ তিনি আগেও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নৈতিকতা পুলিশের একটি ঘটনা প্রকাশ করেন। নৈতিকতা পুলিশ ২৮ এপ্রিল একটি পার্কে শিশুকে নিয়ে হাঁটতে থাকা এক দম্পতিকে অভিযুক্ত করে এবং তাদের পরিচয়পত্রের নম্বর জানানোর দাবি করে।
তারা পরীক্ষা করতে চেয়েছিল ওই নারী আগে কোনো নৈতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন কিনা। বাগবিতণ্ডার পর পুলিশ মারিয়া আরেফি নামে ওই নারীর ওপর মরিচের গুড়া স্প্রে করে এবং তার স্বামী সাবেক ইরানি বক্সিং চ্যাম্পিয়ন রেজা মোরাদখানিকে চারবার গুলি করে। জরুরিভিত্তিতে রেজার ১২ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার করা হয়।
সংস্কারপন্থি হাম্মিহান পত্রিকার প্রতিবেদক এলাহেহ মোহাম্মদিকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। তার দোষ, তিনি মাহসার শহর সাকযে অনুষ্ঠিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার একটি মর্মান্তিক বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি শুধু মাহসার পরিবারের যন্ত্রণা তুলে ধরেননি, একই সঙ্গে পুরো ঘটনাকে পুলিশ যে ধামাচাপা দিচ্ছে সেটা নিয়ে পরিবারের অভিযোগও তুলে ধরেন। করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় কারচাক কারাগারের অভ্যন্তরে নাজুক পরিস্থিতি প্রকাশ করার পর ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এক বছরের জন্য লেখালেখিতে নিষিদ্ধ ছিলেন মোহাম্মদি।
গণগ্রেপ্তার
অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুলের খেলার মাঠে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর গণগ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মনে হচ্ছে ইরান একটি পুরো উল্টো দুনিয়ায় বসবাস করছে, যেখানে নিরাপত্তারক্ষীরা ক্যাম্পাসে টহল দিচ্ছে ও ছাত্ররা কারাগারের সেল দখল করছে।
সরকার অনিবার্যভাবে পুলিশের প্রতি সহিংসতার অভিযোগের বিরুদ্ধে দৃষ্টিনিবদ্ধ করছে এবং শাসক দলের সমর্থনে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিছিল বের করা হচ্ছে। তারা নারীদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়ানোর বিষয়টিও অস্বীকার করছে।
১৭ বছর ছুঁইছুঁই নিকা শাকরামির মৃত্যুও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে। তারা বলেছেন, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বিক্ষোভে নিকাকে হত্যা করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবার কয়েক দিন ধরে তাকে খুঁজছিল। পরে তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়।
কর্মকর্তারা সরকারি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, নিকার মৃত্যু বিক্ষোভ দমনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তিনি দুর্ঘটনাবশত ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তবে নিকার মার দাবি, তার মেয়ে আত্মহত্যা করেননি। তাদের যেসব আত্মীয় শাসকদের টিভিতে গিয়ে সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছেন, তার পুরোটাই সাজানো।
অন্যদিকে, ১৬ বছর বয়সী সারিনা ইসমাইলজাদেহর মায়ের দাবি তার মেয়ে পুলিশের ব্যাটনের আঘাতে নিহত হয়েছেন। এখানেও পুলিশ বলছে সারিনা আত্মহত্যা করেছেন।
কয়েকজন বিক্ষোভকারী গার্ডিয়ানকে বলেছেন, তাদের এখন আর পিছু হটার সম্ভাবনা নেই।
একজন বলেন, ‘আমরা তাদের (শাসক) বিধিনিষেধ সহ্য করব না। কঠোর পোশাক নীতি মেনে চলব না। আমাদের জীবন ও আমাদের পছন্দের অধিকার আছে। আমি রাস্তা-ঘাটে মৃতদেহ দেখেছি, তাদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না।’
গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়েনি, জোর করে তাদের পিছু হটিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। একইসঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ক্ষীণ প্রত্যাশা রয়েছে, সরকার স্বেচ্ছায় নৈতিকতা পুলিশের ভূমিকায় সংশোধন আনবে।
বিক্ষোভের মূল কারণ জানতে রাজনৈতিক অভিজাতরা আত্ম-অনুসন্ধান করেছেন। তারা এও বোঝার চেষ্টা করছেন নৈতিকতা পুলিশের নৃশংস পদ্ধতি তরুণ প্রজন্মের মন পরিবর্তনে সক্ষম কিনা। বিশেষ করে যখন তরুণদের অনেকেই ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছেন।
অভিজাতদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীকার করছেন, ২০২১ সালে রাইসি নির্বাচনে জয়ী হলেও প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। রাইসি ভোটারদের মাত্র ২৫ শতাংশের সমর্থন পান।
তেহরান সম্মিলিতভাবে ইরানে চলমান রাজনৈতিক প্রহেলিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমন অবস্থায় কেবল সরকারি আদেশ দিয়ে একটি সাংস্কৃতিক ক্র্যাকডাউন চাপিয়ে দেয়া ঝামেলাপূর্ণ।
আয়াতুল্লাহ খামেনির ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ও আত্মীয় গোলামালি হাদ্দাদ-আদেল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজ দ্রুত আল্লাহবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমারা আমাদের দেশের জন্য যে সমস্যাটি তৈরি করেছে তা হলো পরিবারকে ধ্বংস করা। কারণ পরিবার হল ধার্মিকতার শয্যা। পরিবার নড়বড়ে হয়ে গেলে ধার্মিকতা শেকড়সহ পুড়ে যাবে।’
ইরানের বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মনেতাদের একজন নাসের মাকারেম শিরাজি দাঙ্গার জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন: ‘বিদেশি শত্রু, ভার্চুয়াল বা অনলাইন জগত ও মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবিকা সমস্যা।’
অন্যরা ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে ঘিরে পশ্চিমা ঈর্ষাকে দায়ী করেছেন। ইসলামবাদের বিপরীতে জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে তারা ইরানকে ভেঙে ফেলার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন।
তবে সরকার স্পষ্টতই বিক্ষোভের তীব্রতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। বিক্ষোভকারীদের তারা দুর্বল হিসেবে বিবেচনা করছে। কট্টরপন্থিরা নজিরবিহীন ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের দমনের আহ্বান জানাচ্ছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে হিরব বা আল্লাহ বিরোধিতার অভিযোগ এনে বিচারের দাবি তুলছেন। ইরানে এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এটি পরিস্থিতিকে আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে।