ইরানে পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণ আঘাতজনিত নয়, বরং বিশেষ কোনো শারীরিক অসুস্থতায় তিনি মারা যান বলে দাবি করেছে দেশটির সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন। ফরেনসিক মেডিসিন অর্গানাইজেশন এক বিবৃতিতে এ দাবি করেছে। তবে এই বিবৃতিতে মাহসাকে আঘাতের তথ্য অস্বীকার করা হয়নি।
বিবৃতিতে শুক্রবার প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক মেডিক্যাল প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়, ‘মাথা এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে আঘাতের কারণে মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়নি। অচেতন হয়ে পড়ার সময়ে কয়েক মিনিট মাহসার হৃৎযন্ত্র ও ফুসফুস অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে তিনি গুরুতর হাইপোক্সিয়ায় (অক্সিজেন ঘাটতি) আক্রান্ত হন। পরে হৃৎযন্ত্র ও ফুসফুস সচল হলেও তার মস্তিষ্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
তবে মাহসার পরিবার ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন শুরু থেকেই দাবি করছে, গ্রেপ্তারের সময় মাহসার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লাঠির আঘাত করে পুলিশ। এ কারণেই পরে তিনি চেতনা হারিয়ে কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাহসা ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
গ্রেপ্তারের সময় মাহসার সঙ্গে ছিলেন তার ভাই কিয়ারশ আমিনি।
কিয়ারশ সম্প্রতি ইরানওয়্যারকে বলেন, ‘আমার এখন হারানোর আর কিছুই নেই। আমি ইরানের সবাইকে জানাব কী হয়েছিল।’
তিনি জানান, তাদের পরিবার রাজধানীতে ঘুরতে এসেছিল। শহীদ হাঘানি এক্সপ্রেসওয়ের প্রবেশপথে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে নৈতিকতা পুলিশের টহল ভ্যান তাদের গতিরোধ করে।
পুলিশ মাহসাকে জোর করে ভ্যানে তুলে নেয়। তার ভাই এ সময় বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। নৈতিকতা পুলিশের দলটি যাওয়ার সময় জানায়, মাহসাকে তারা নিজেদের স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে এবং ১ ঘণ্টার ‘শিক্ষা সেশন’ শেষে ছেড়ে দেয়া হবে।
পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে কিয়ারশ বলেন, ‘আমি ওদের (নৈতিকতা পুলিশ) ভবনের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার সঙ্গে আরও অনেকে ছিলেন। এ সময় হঠাৎ ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাই।
‘আমরা সবাই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। হঠাৎ পুলিশ সদস্যরা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের লাঠিপেটা এবং টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করে। আঘাতে আমার সারা শরীর কালো আর নীল হয়ে গিয়েছিল। কাঁদানে গ্যাসের কারণে চোখ জ্বলছিল। এর ৫ মিনিট পর একটি অ্যাম্বুলেন্স ভবনটি থেকে বেরিয়ে যায়।’
কিয়ারশ বলেন, ‘এ সময় বন্দি অনেক নারী ছুটে বেরিয়ে আসেন। তারা বলছিলেন ভেতরে কেউ মারা গেছে। আমি তাদের মাহসার ছবি দেখালাম। একজন বললেন, ঘটনাটি ঘটার সময় মাহসা তার পাশে ছিল।
‘আমি হতবাক ও আতঙ্কিত হয়ে যাই। এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। তিনি বললেন, তাদের একজন আহত হয়েছেন। তিনি আসলে মিথ্যা বলছিলেন। আমি তাকে বিশ্বাস করিনি। সেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিল মাহসা। আমি ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে গিয়েছি।’
সেদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে চিকিৎসকরা মাহসার পরিবারকে জানান, তাকে বাঁচানো যাবে না। তিনি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তার হৃৎপিণ্ড সচল থাকলেও মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কোমায় চলে যাওয়া মাহসার মৃত্যু হয় ১৬ সেপ্টেম্বর।
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ। হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটে মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ইরানের নারীরা। বিভিন্ন দেশের তারকরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন ইরানি নারীদের।
বিক্ষোভ ঠেকাতে ইরানের নিরাপত্তাবাহিনী সহিংস হয়ে উঠেছে। নরওয়েভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস বৃহস্পতিবার জানায়, বিক্ষোভে অন্তত ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেক মানুষ।