ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে চলমান প্রবল বিক্ষোভে প্রাণহানি বাড়ছে। বলা হচ্ছে, দুই সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভে অন্তত ৮৩ জন নিহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ না এলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে সতর্ক করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ইরান। অন্তত ৮০ শহরে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ দমাতে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করছে প্রাণঘাতী অস্ত্র।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, চলমান বিক্ষোভে পুলিশসহ অন্তত ৮৩ জনের প্রাণ গেছে। এ খবরের পর পরই নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিবৃতি দেয় মানবাধিকার সংস্থা- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া সংকট থেকে বেরোনো কঠিন।
রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন হিজাববিরোধীরা
অ্যামনেস্টি বলেছে, ‘ইরানি সরকার তাদের ক্ষমতার প্রতি যেকোনো চ্যালেঞ্জ নস্যাৎ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশজুড়ে চলা বিক্ষোভকে নির্মমভাবে দমন করতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করছে।
‘নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি না দিয়ে সমন্বিত সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। তা না হলে অগণিত মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু, পঙ্গুত্ব, নির্যাতন এবং বন্দিত্ব।’
- আরও পড়ুন: বিশ্ববাসীকে বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান ইরানি অস্কারজয়ীর
- আরও পড়ুন: ইরান বিক্ষোভে ভাইরাল সেই তরুণী কি গুলিতে নিহত?
বিক্ষোভে সহিংস ঘটনার ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, হতাহতের বেশির ভাগ ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি গুলিতে ঘটেছে।
ইরানের অন্তত ৮০ শহরে ছড়িয়েছে বিক্ষোভ
এনজিওটি আরও জানায়, ২১ সেপ্টেম্বর ইরানের সব প্রদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারদের কাছে জারি হওয়া একটি গোপন নথি হাতে পেয়েছিল তারা। এতে বিক্ষোভকারীদের ‘কঠোরভাবে মোকাবিলা করার’ নির্দেশ ছিল।
আরেকটি ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, ২৩ সেপ্টেম্বর মাজানদারানের নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দয়তার সঙ্গে বিক্ষোভ মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রদেশটির সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার।
অ্যামনেস্টি বলছে, বিক্ষোভে ৫২ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তারা। তবে প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত বেশি। কিন্তু অসলোভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস বলছে, এ পর্যন্ত ৮৩ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে তারা।
বিরোধীমত দমনে জোর অভিযান
ওয়াশিংটনভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) বলছে, বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে অন্তত ২৫ সাংবাদিককে আটক করেছে ইরানি পুলিশ। এই তালিকায় আছেন মাহসা আমিনির দাফনের খবর কাভার করা সাংবাদিক ইলাহে মোহাম্মদি। বৃহস্পতিবার তাকে হেফাজতে নেয় নিরাপত্তা বাহিনী।
এর আগে শার্ঘ ডেইলির সাংবাদিক নিলুফার হামেদিকে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনী। মাহসা কোমায় থাকা অবস্থায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। তার কারণেই পুরো ঘটনা বিশ্বের কাছে প্রকাশ পায়।
ইয়াজদ শহরে গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন নারীরা
আলোচিত ফটোসাংবাদিক ইয়ালদা মোয়াইরিকে ১৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ কাভার করার সময় আটক করে পুলিশ। ২০১৯ সালে ইরানে জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে হওয়া বিক্ষোভের একটি আইকনিক ছবির জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন মোয়াইরি।
- আরও পড়ুন: ইরান সরকারের রোষানলে সাংবাদিকরাও
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের ধরতে দেশের ভেতর বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে ইরানি পুলিশ। যারা মাহসা ইস্যুতে খবর সংগ্রহ করেছেন, তারা আছেন বেশি আতঙ্কে। এসব খবর যেন না ছড়াতে পারে, সে জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিত করে দিয়েছে ইরান সরকার।
১৮ সেপ্টেম্বর তেহরানের একটি পত্রিকায় মাহসার ছবি প্রচ্ছদে ব্যবহার হয়
আটক হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানির মেয়ে ফাইজেহ হাশেমিও। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন ইরানের সাবেক তারকা ফুটবলার হোসেইন মানাহি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্ষোভকে সমর্থন জানানোর অপরাধে শুক্রবার তাকে আটক করা হয়।
এর আগে সংগীতশিল্পী শেরভিন হাজিপুরকে আটক করা হয়। বিক্ষোভ নিয়ে তার ‘বারায়ে’ (তোমার) গানটি ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হয়েছে। এখন অবশ্য গানটি তার অ্যাকাউন্ট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
বিক্ষোভ যেভাবে শুরু
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান মাহসা আমিনি
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ।
ইতিহাস
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটির ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকার ঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন।