উত্তর প্রদেশের একটি গাছ থেকে দুই বোনকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যাওয়ার কয়েক দিন পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছে ধর্ষণ শেষে তাদের খুন করা হয়েছিল। নিহতদের পরিবার এখন অপূরণীয় এই ক্ষতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টায় আছে।
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনউ থেকে ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) দূরে তামোলি পুরভা গ্রামটি। বুধবার রাত থেকে এখানে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়িতে যাওয়ার সরু পথটি এখন কাদায় মাখামাখি। দুই রুমের বাড়িটি থেকে ধূসর আকাশ অনেকটা স্পষ্ট দেখা যায়।
দলিত সম্প্রদায়ের দুই কিশোরীর মরদেহ যেখান থেকে উদ্ধার হয়, বাড়িটি সে জায়গা থেকে খুব দূরে নয়। বলা হচ্ছে, সেই আখক্ষেতে প্রথমে ধর্ষণ করা হয় ১৫ ও ১৭ বছরের দুই বোনকে। তারপর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় তাদের।
একটি মোটরবাইকে আসা তিন ব্যক্তি বুধবার বিকেলে তাদের তুলে নিয়ে যায়। ঘটনার একমাত্র সাক্ষী তাদের মা। বিছানায় বসে এখন তিনি বিলাপ করছেন, তাকে ঘিরে আছেন আত্মীয়স্বজনরা।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি অসহায়। আমার মেয়েরা চলে গেছে। এখন আমি কীভাবে বাঁচব? তারা এই বিছানায় ঘুমাত।’
কিছুক্ষণ এভাবে কান্নার পর কিছুটা শক্ত হন ওই নারী। এবার তার চোখে-মুখে প্রতিশোধের আগুন।
তিনি বলেন, ‘আমি তাদের ফাঁসি দেখতে চাই; যেভাবে তারা আমার মেয়েদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে।’
দুই কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের একজন প্রতিবেশী; বাকিরা পাশের গ্রামের।
ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বুধবারের ঘটনা ভারতের আট কোটি দলিত নারীর ওপর যৌন সহিংসতাকে নতুন করে সামনে এনেছে। দলিত এমন একটি সম্প্রদায়, যারা ভারতের গভীর বৈষম্যমূলক বর্ণ শ্রেণিবিন্যাসের একেবারে তলানিতে রয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, বর্ণভিত্তিক যৌন সহিংসতা বাড়ার কারণ ‘অদক্ষ শাসন’। এসব অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পুলিশ অনেক সময় নেয়। এ ছাড়া বাদীকে নানাভাবে নাজেহাল করার অভিযোগও বিস্তর। অতীতে বহুবার দোষীদের রক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে তদন্ত শুরু করে প্রশাসন।
পুলিশ বলছে, এই দুই বোনের দুজন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কারণ তারা বিয়ের জন্য তাদের চাপ দিচ্ছিল, ওরা রাজি হচ্ছিল না। তবে পুলিশের এ দাবি উড়িয়ে দিয়েছে মেয়েদের পরিবার।
১৭ বছরের মেয়েটি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল তাদের মায়ের অসুস্থতার কারণে। সে বাড়ির যাবতীয় কাজগুলো করত।
তাদের মা বলেন, ‘ছয় মাস আগে আমার একটি অস্ত্রোপচার হয়। সে থেকেই আমার বড় মেয়ে বাড়ির সব কাজ করত।
মেয়েদের বাবা ২৫০ রুপিতে দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি বলেন, ছোটটার পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। সে পাশের শহরের একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। কথা দিয়েছিলাম, হাইস্কুল শেষ করতে আমি তাকে সাহায্য করব।’
ছোট্ট একটি গ্রামে ছিল এই দুই বোনের বাস। ফলে সুযোগ-সুবিধাও অনেক কম পেত তারা। তবে তাদের পরিবার বলছে, দারুণ মেধাবী ছিল তারা, স্বপ্ন ছিল অনেক।
১৭ বছরের বড় বোন সেলাইয়ের কাজে ছিল দক্ষ। তাদের বড় ভাই বলেন, ‘চার মাস ধরে পাশের গ্রামে ও সেলাইয়ের কাজ শিখত। আমি ওকে আনা-নেয়া করতাম। মার্চে হোলি উৎসবের সময় তাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দিই।’
পাশ থেকে তাদের মা গোলাপি একটা ব্লাউজ দেখিয়ে জানান, এটি তার বড় মেয়ে তৈরি করে দিয়েছিল তাকে।
ছোট মেয়েটির ছিল আঁকাআঁকির শখ। একটি খাতায় ছোট মেয়ের আঁকা নকশা দেখিয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তাদের মা।
ছোট মেয়ের পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি দেখিয়ে তাদের এক খালা বলেন, ‘সে অনেক স্বপ্ন দেখত। পড়াশোনা করতে চেয়েছিল, বিউটি পার্লার খুলে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল। স্বপ্নগুলো এখন চিরতরে হারিয়ে গেছে।’
২০ কোটির বেশি জনসংখ্যার উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য। এখানে দীর্ঘদিন ধরে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। রাজ্যের দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত নিম্নবর্ণের নারীরা থাকেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
লখিমপুরে ফিরে যাই। মেয়েদের ভাই স্মরণ করছেন, বোনদের সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার দিনটি।
তিনি বলেন, ‘শেষ রাখি উৎসবের সময় (আগস্টে) বাড়ি ফিরেছিলাম। তখনই তাদের সঙ্গে শেষ দেখা। আমরা সবাই তখন অনেক মজা করেছিলাম।
‘সবাই খুব খুশি ছিলাম। কখনই ভাবিনি, আমাদের গ্রামে এ রকম কিছু ঘটতে পারে। আমার বোনেরা খুব নিরাপদ জীবনযাপন করত, তারা কখনও একা কোথাও যায়নি। তার পরও তাদের সঙ্গে এমনটা ঘটতে পারলে, কেউই নিরাপদ নয়।’