মারিয়ানা মামোনোভা একজন সামরিক চিকিৎসক। পরিবার ছেড়ে মারিউপোল শহরে আহত সেনাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন এই ইউক্রেনীয় নারী। এপ্রিলে রুশ সেনাদের হাতে যখন বন্দি হন, মারিয়ানা তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
মারিয়ানাকে আরও অনেক যুদ্ধবন্দির সঙ্গে রাখা হয় পূর্ব ইউক্রেনের কালমিউস্কে রায়ওন অঞ্চলের ‘কুখ্যাত’ জেল-ওলেনিভকায়। কারাগারটি ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার দখলে। এখানকার পরিস্থিতি এতটায় বাজে যে বিভিন্ন সময়ে কারাগারটি খবরের শিরোনাম হয়েছে।
মারিয়ানার স্বামী ভাসিলি। স্ত্রীর বন্দি হওয়ার বিষয়টি তিনি জানতে পারেন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।
ভাসিলি বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসছে। দুঃখের বিষয় হলো, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে সরাসরি দেখতে পাইনি। সে মারিউপোলে সম্মুখ সারির যোদ্ধা ছিল।
‘আমার মনে হয়, খুশির খবরটি ও আমাকে সরাসরি বলতে চেয়েছিল। তাই ইন্টারনেটে সে আমাকে ইঙ্গিতপূর্ণ একটা ইমোজি পাঠিয়েছিল। এটি ছিল নবজাতকের সঙ্গে বাবা-মায়ের একটি ইমোজি।’
বাবা হতে যাচ্ছেন খবরটি জানার কয়েক সপ্তাহ পর, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাসিলি জানতে পারেন তার স্ত্রী রুশ বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছেন।
রুশ অধিকৃত দোনেৎস্ক অঞ্চলের ওলেনিভকা কারাগারটির অবস্থা নাজুক। সম্প্রতি এক হামলায় এই জেলের কমপক্ষে ১২ জন ইউক্রেনীয় নিহত হন। ওই হামলার জন্য একে-অপরকে দুষছে মস্কো ও কিয়েভ।
২০১৮ সাল থেকে সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন মারিয়ানা। ছবি: সংগৃহীত
চলতি মাসের শেষদিকে প্রথম সন্তানের জন্ম দেবেন মারিয়ানা। এ কারণে বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় দ্রুত মারিয়ানাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে ইউক্রেন সরকারের কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার।
মারিয়ানার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তথ্য খুব কম; যদি মুক্তি না পান তবে কারাগারেই জন্ম দিতে হবে সন্তান। জেলে জন্ম নেয়া নবজাতকের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা স্পষ্ট নয়।
ইউক্রেনীয় সরকার বলছে, মারিয়ানা ভালো আছেন। বিষয়টিকে সরকার বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
ওলেনিভকায় মারিয়ানার সঙ্গে একসময় বন্দি ছিলেন আনা ভোরোশেভা। দু’মাস আগে জুলাইয়ে মুক্তি পান তিনি।
ভোরোশেভা বলেন, ‘শুরুতে মারিয়ানা ২০ জনেরও বেশি বন্দির সঙ্গে একটি রুমে ছিলেন, তাকে মেঝেতে ঘুমাতে হতো।
‘আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলতাম। সে বলেছিল যে সে গর্ভবতী। এটা শুনে ওর প্রতি আমরা বাড়তি যত্ন নিতাম। ঠিকমত খাবার পাচ্ছে কি না, রুমে তাজা বাতাস আসছে কি না... এসব।’
এক সময় মারিয়ানাকে ছোট একটি রুমে সরিয়ে নেয়া হয়। ওই রুমে তুলনামূলক কম বন্দি, বিছানাও দুটি। একটিতে ঘুমাতেন মারিয়ানা।
ভোরোশেভার বলেন, ‘প্রথম দিকে বন্দি বিনিময়ের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন মারিয়ানা। আমরা সবাই ভেবেছিলাম গর্ভাবস্থার কারণে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
‘তিনি একজন চিকিৎসক। শরীরের অবস্থান তিনি ভালোই বোঝেন। শিশুটি সময়মতো লাথি মারতে শুরু করায় তিনি বলেছিলেন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।’
জুনের শেষের দিকে এক কারারক্ষী মারিয়ানাকে জানান, আরও অন্তত দেড় মাস তাকে বন্দি থাকতে হবে, অর্থাৎ সন্তান জন্মের ছয় সপ্তাহ আগে মুক্তি পাবেন তিনি।
ভোরোশেভার বলেন, ‘এ খবরে মারিয়ানা চিন্তায় পড়ে যান। তার মনে হতে থাকে, বন্দি অবস্থায় হয়ত সন্তান জন্ম দিতে হতে পারে তাকে।
‘দোনেৎস্ক অঞ্চলের চিকিৎসা সেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এখানে সন্তান জন্ম দেয়া সত্যিই ভয়ের বিষয়।’
সঠিক চিকিৎসা ছাড়া সন্তান জন্ম দেয়ার বিপদের পাশাপাশি মারিয়ানা অন্য একটা কারণেও উদ্বিগ্ন। তার ভয়, শিশুটিকে কেড়ে নেয়া হবে। একই শঙ্কায় দিন কাটছে মারিয়ানার স্বামী ভাসিলিরও।
ভাসিলি বলেন, ‘আমার সন্তানকে এই অবস্থায় রাখা যাবে না। তারা ওকে নিয়ে যেতে পারে। মারিয়ানাকে এখনই ঝুঁকি নিতে হবে।’
মারিয়ানার কাছের বন্ধু কেসনিয়া ফারিনা। তিনিও এক সময় বন্দি ছিলেন। ওই কারাগারের অনেক সাবেক বন্দির সঙ্গে যোগাযোগ আছে ফারিনার।
তিনি বলেন, ‘মারিয়ানাকে বলা হয়েছিল, তার সন্তানের বয়স তিন বছর হওয়ার পর, তাকে তার থেকে আলাদা করা হতে পারে।’
মারিয়ানার (বাঁয়ে) সঙ্গে কেসনিয়া ফারিনা। ছবি: সংগৃহীত
মারিয়ানার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দেয়নি দোনেৎস্ক কর্তৃপক্ষ বা রাশিয়ান সামরিক বাহিনী। বন্দি অবস্থায় সন্তান জন্ম দিলে কী হবে, তাও জানতে পারেনি বিবিসি।
মারিয়ানার বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা রাশিয়ান প্রোপাগান্ডা ভিডিও থেকে মারিয়ানার বন্দি হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে।
ভিডিওটি ৪ এপ্রিল টেলিগ্রামে পোস্ট করেন চেচনিয়ার শাসক রমজান কাদিরভ। এতে দেখানো দুই শতাধিক ইউক্রেনী বন্দিকে। দাবি করা হয়, তারা রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ওই ভিডিও দেখে মারিয়ানাকে চিনতে পারেন তার বন্ধুরা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বন্দিদের একটি ভিডিওতে মারিয়ানার পরিবার তাকে চিনতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত
মারিয়ানাকে মুক্ত করতে ইউক্রেন সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে তার পরিবার। কিয়েভ শাসকরা তাদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়।
ভাসিলি বলেন, এ সময়ে কয়েক দফায় বন্দি বিনিময় হয়। তবে কেন জানি সে বাদ পরে যেত।’
ফারিনা বলেন, ‘শুরুতে মারিয়ানা আশাবাদী এবং ইতিবাচক ছিলেন। তবে মারিউপোলের অবস্থার অবনতি হওয়ায়, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন তিনি। মারিয়ানার কাছ থেকে ১৭ মার্চের শেষ বার্তাটি পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, আমি বেঁচে আছি।’