ভারতে টানা দুই বছর করোনাভাইরাস মহামারির পরে এ বছর দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে
আবার চাঙা হয়ে উঠেছে মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত পশ্চিমবঙ্গের কুমারটুলি।
দুর্গাপূজার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। ১ অক্টোবর ষষ্ঠী। দুর্গা প্রতিমার চাহিদা মেটাতে আর সময়মতো ক্রেতার হাতে মূর্তি তুলে দিতে কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা এখন মগ্ন প্রতিমার কাজে, তুলির টানে।
কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীর হাতে তৈরি দুর্গা প্রতিমার নামডাক বিশ্বজুড়েই। শুধু রাজ্যের মধ্যে নয়, ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখান থেকেই দুর্গা প্রতিমা যায়।
বিদেশে দুর্গা প্রতিমা বিক্রি করে ভালো দাম পান এখানকার মৃৎশিল্পীরা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষকদের মতে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রাজ্যে প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপির ব্যবসা হয়। কুমারটুলির মৃৎশিল্পীদের সেখানে একটা বড় অবদান থাকে।
করোনাভাইরাস মহামারির জন্য গত দুই বছর বিশ্বের কোথাও সেভাবে দুর্গোৎসব উদযাপন হয়নি। কিন্তু এবার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় এ বছর আবার দুর্গোৎসব উদযাপনে মেতেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাঙালিরা।
প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত কুমারটুলির মৃৎশিল্পী
দেশে-বিদেশে দুর্গা প্রতিমার চাহিদা মেটাতে কুমারটুলির মৃৎশিল্পের বাজার এখন তুঙ্গে। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যেও যায় কুমারটুলির দুর্গা প্রতিমা।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রচুর মানুষ এখানে কাজ করে তাদের সংসার প্রতিপালন করেন। সারা বছর এখানে মূর্তি তৈরির কাজ চলে। দিনপ্রতি ৫০০ থেকে হাজার ১ হাজার ২০০ টাকা মজুরি পান এর সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা।
কোনো কোনো প্রতিমা তৈরির কারখানায় শ্রমিকদের মাসিক বেতনেরও ব্যবস্থা আছে। সেখানে আট হাজার থেকে ৩০-৪০ হাজার রুপি বেতন পান অনেকে।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের মোহন দাস কুমারটুলির বিখ্যাত মৃৎশিল্পী সুবল পালের কারখানায় ৭০০ টাকা ডেইলি রোজে কাজ করেন। করোনার জন্য বিগত দুই বছর কাজ ছাড়া বাড়িতে বসে ছিলেন।
প্রচণ্ড অর্থকষ্টে ধার-দেনা করে সংসার চালিয়েছেন। এবার আগের মতো সাড়ম্বরে পূজা হচ্ছে। হাতে কাজের চাপ থাকায় খুশি মোহন।
মোহন বলেন, 'এবার আগের মতো প্রতিমা তৈরির কাজের চাপ রয়েছে। দুটো পয়সা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতে পারব। আমি খুশি। মার কাছে প্রার্থনা করি, সবাই যেন পূজার আনন্দে মেতে উঠতে পারে।'
শুধু কুমারটুলির কারখানায় নয়, কলকাতার বিভিন্ন প্যান্ডেলে গিয়েও কাজ করতে হয় প্রতিমাশিল্পীদের। পূজার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি।
সময়মতো উদ্যোক্তাদের হাতে দুর্গা প্রতিমা তুলে দিতে এবার কাজের চাপে শিল্পীরা খাবার, অন্য কাজকর্মের সময় ঠিকমতো না পেলেও সবাই ভীষণ খুশি। আগের মতোই আবার সরগরম কুমারটুলির পোটো পাড়া।
কুমারটুলির বিখ্যাত প্রতিমাশিল্পী কৌশিক ঘোষের তৈরি দুর্গা প্রতিমা মূলত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যায়। এ বছর তার তৈরি ৩৪টি প্রতিমা বিদেশে গেছে। নিউজ বাংলাকে কৌশিক ঘোষ বলেন, ‘কলকাতায় এ বছর আমার কোনো প্রতিমা নেই । আমার তৈরি সমস্ত দুর্গা প্রতিমা বিদেশে যায়। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ অনেক দেশে এবার ৩৪টি ঠাকুর (প্রতিমা) গিয়েছে। গত দুই বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য বেশি প্রতিমার অর্ডার ছিল না। অল্প কিছু পাঠাতে পেরেছিলাম। এবার আবার স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী ঠাকুর তৈরি হয়েছে। আমরা খুশি।’
ফাইবার গ্লাসের বিশেষভাবে তৈরি এসব প্রতিমা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই জাহাজে করে পাঠানো হয়েছে বিদেশে।
সাধারণত প্রতিমা পৌঁছতে তিন-চার মাস সময় লেগে যায় বলে জানান কৌশিক।
কুমারটুলির প্রতিমা বিদেশেও রপ্তানি হয়
পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছেন কুমারটুলির প্রখ্যাত প্রতিমাশিল্পী সুবল পাল । ২০ বছর ধরে বিদেশে ঠাকুর পাঠান তারা।
নিউজবাংলাকে সুবল পাল বলেন, ‘খুবই আর্থিক এবং মানসিক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমরা। করোনার দুঃসময়টা শেষ হওয়া দরকার। এখন এই যে এত বড় একটা উৎসব, যেটাকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়, সকলের রুটিরুজির ব্যবস্থা হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে পুজোটা ভালো হওয়া খুব দরকার ছিল।
‘যে বাঙালিরা বিদেশে পুজো করেন সেখানে এ বছর অনেক ভালোভাবে পূজা হচ্ছে। অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি চলছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জাহাজে করে ইউএসএ, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া ও মাদ্রিদে ঠাকুর পাঠিয়েছি। কলকাতায় তিনটি সর্বজনীন মণ্ডপে এবং তিনটি ঘরোয়া প্রতিমা রয়েছে আমার।’
সাইবার গ্লাসের তৈরি এইসব প্রতিমার দাম এক লাখ থেকে শুরু করে ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ওঠে ।
কলকাতার দুর্গা পূজাকে ইউনেসকো কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটির স্বীকৃতি দেয়ায় দুর্গোৎসব এবার অনেক আড়ম্বরপূর্ণ হবে বলে জানিয়ে সুবল পাল বলেন, ‘দুর্গাপূজা শুধু পূজা নয়, একটা উৎসব, এটা একটা আর্ট ফেস্টিভ্যাল। এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বহু মানুষ তাদের সারা বছরের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেন।’