বৈশ্বিক জলবায়ু যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। এই খরা, এই বৃষ্টির দেখা মুহূর্তেই। জলবায়ুর এমন সংকটময় অবস্থায় অনাকাঙিক্ষতভাবে বন্যায় ডুবে যাচ্ছে বহু এলাকা। আবার খরায় পড়ছে একটির পর একটি দেশ। দুর্যোগের এ তালিকায় এবার যোগ হয়েছে পাকিস্তান।
আগেও দেশটিতে বন্যা হয়েছ বহুবার। মানুষও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। তবে সমস্যা কেটেছে হিসাবমতো সময়েই। কিন্তু এবারের বন্যা সব পূর্বাভাস যেন দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ভাসছে প্রায় পুরো দেশই।
দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, নদীর বাঁধ ভেঙে পড়া ও পাহাড়ি ঢল। এ প্রেক্ষাপটে জুনে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটিতে অন্তত ১ হাজার ১৩৬ জন বন্যার কারণে মারা গেছেন।
বন্যার ভয়াবহতা নিয়ে ইসলামাবাদের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. ফাহাদ সাঈদ বলেন, আমরা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী হচ্ছি।
পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী শেরি রহমান জানিয়েছেন, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে গেছে৷ এমন বৃষ্টি পাকিস্তান এর আগে কখনও দেখেনি।
তিনি বলেন, টানা আট সপ্তাহের বিরতিহীন বৃষ্টির পানির নিচে চলে গেছে দেশ। চতুর্দিক থেকে দুর্যোগ শুরু হয়েছে। দানবের মতো বর্ষা সারা দেশে অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে।
পাকিস্তানের আগে বাংলাদেশ ও ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পাহাড়ি ঢলের মতো বিষয়গুলোও এই দুর্যোগের জন্য দায়ী বলে বের করেছেন গবেষকরা।
গবেষণায় উঠে এসেছে, চলতি মাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে বৃষ্টিপাত হয়েছে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় নয় গুণ। সারা দেশে বৃষ্টি বেড়েছে আগের তুলনায় পাঁচ গুণ।
এই অতিবৃষ্টির পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির পরিবেশ।
২০১০ সালে বন্যায় ব্যাপকভাবে পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সময়ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে আসে। ২০২১ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বৈশ্বিক উষ্ণতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বন্যা এবং এর তীব্রতা বাড়াচ্ছে। প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টি বাড়ছে ৫ শতাংশ।
২০১০ সাল থেকে নিয়মিত বন্যার পাশাপাশি তাপপ্রবাহ এবং দাবানলের শিকার হচ্ছে পাকিস্তান। এ নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানী ফাহাদ সাঈদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন সত্যিকার অর্থেই আমাদের প্রভাবিত করছে। প্রতি বছর এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়াটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ঝুঁকি এবং স্থিতিস্থাপকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. লিজ স্টিফেনসের মতে, পাকিস্তানে এখন যে বন্যা, এমন বন্যা ১০০ বছরে একবারেরও কম প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের বন্যায় ১৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এবারের বন্যা তার চেয়েও ভয়ংকর।
চলতি বন্যায় দ্রুত এলাকাগুলো ডুবে যাওয়া এবং বাঁধ ভেঙে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
একজন বিশ্লেষক বলেন, কখন যে কোন এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে তা কেউ বলতে পারছে না। স্বাভাবিকভাবেই আগে এমন পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় মানুষ দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারছে না।
বন্যার ভয়াবহতা বাড়ার পেছনে বন উজাড় ও নদীর বাঁধগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কয়েকজন বিশ্লেষক।
উন্নয়ন ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আলী তৌকির শেখ বলেন, আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটির ওপর নজর না দিই, তবে এখন যা দেখছি তা হবে আগামী দিনের দুর্যোগের ট্রেইলার মাত্র।
বিবিসি বলছে, পাকিস্তানের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি পাকিস্তানি, অর্থাৎ প্রতি ৭ জনের ১ জন এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বন্যার পানিতে ব্রিজ ও রাস্তা ভেসে গেছে। গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিপর্যস্ত পাকিস্তানে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে দেশটির সেনা সদস্যরা। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে হেলিকপ্টারের সাহায্যেও কর্তৃপক্ষ আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে। বন্যাক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে যারা পালাতে সক্ষম হয়েছে, তাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বন্যা আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনের পর বলেছেন, ‘গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। লক্ষাধিক বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান এরই মধ্যে বন্ধুপ্রতিম দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছে।