ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সাতটি গ্রামের শত শত বাসিন্দা পিঁপড়ার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তারা বলছেন, পিঁপড়ার দল তাদের গবাদিপশুকে আক্রমণ করছে। তাদের ফসলি জমি, তাদের ঘরবাড়ি কিছুই উপদ্রব থেকে বাদ পড়ছে না।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার অনুসারে, হলুদ পিঁপড়া বা ইয়েলো ক্রেজি অ্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক প্রজাতির মধ্যে অন্যতম। এই প্রজাতির পিঁপড়া কামড় দেয় না। তবে তারা এক ধরনের ফরমিক অ্যাসিড ছোড়ে, যা ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এই পিঁপড়ার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যানোপ্লোলেপিস গ্র্যাসিলিপস। এদের বাস গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে। তারা অনিয়মিত, সমন্বয়হীনভাবে চলাফেরা করে। তবে চলাফেরার সময় তারা কোনো বাধা পেলে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রজাতির পিঁপড়া দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। তারা দেশীয় বন্য প্রাণীর প্রচুর ক্ষতি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার অনেক অংশে এই পিঁপড়ার উপদ্রবের খবর পাওয়া গেছে।
ড. প্রণয় বৈদ্য একজন কীটবিজ্ঞানী। তিনি হলুদ পিঁপড়ার ওপর অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই প্রজাতির পিঁপড়া সুবিধাবাদী।
কোনো একটা খাবার তারা বেশি পছন্দ করে এমনটি নয়। তারা সবকিছুই খায়। এই হলুদ পিঁপড়ারা অন্য প্রজাতির পিঁপড়া, মৌমাছি কোনো কিছু খেতেই বাদ রাখে না।
তামিলনাড়ুর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো ডিন্ডিগুল জেলার কারান্থামালাই বনের চারপাশে একটি পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা কৃষিকাজ করেন অথবা গবাদিপশুর মালিক।
তামিলনাড়ুর সেলভাম নামের এক কৃষক বলেছেন, হলুদ পিঁপড়ার উপদ্রবে তারা বনের কাছাকাছি কাজ করতে পারছেন না।
৫৫ বছর বয়সী সেলভাম বলেন, ‘বনের কাছাকাছি গেলেই পিঁপড়া আমাদের গা বেয়ে উঠতে শুরু করে। আমরা খাবার তো দূরের কথা, পানি পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না। পিঁপড়া পানির পাত্রের মধ্যে গিয়েও বসে থাকে। আমরা জানি না এই উপদ্রব থেকে কীভাবে মুক্তি পাব।’
গ্রামবাসী জানান, তারা কয়েক বছর ধরে আশপাশের জঙ্গলে এই পিঁপড়া দেখছেন। কিন্তু সম্প্রতি গ্রামের মধ্যেও তাদের উপদ্রব বেড়েছে। পিঁপড়ার দল তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
বনের আশপাশে বসবাসকারী গবাদিপশু পালকরা বলছেন, উপদ্রবের কারণে তারা সেসব স্থান ছেড়েছেন।
নাগাম্মল নামের এক বাসিন্দা ছাগল পোষেণ। তার খামারের ছাগলগুলোকে পিঁপড়ার দল আক্রমণ করেছিল। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে এই পিঁপড়ার দল হানা দিয়েছিল। তাই আমি গ্রামে চলে এসেছি। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তাদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই।’
স্থানীয় বন কর্মকর্তা প্রভু বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছি। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।’
ডা. সিঙ্গামুথু একজন সরকারি পশু চিকিৎসক। তিনি বলেছেন, পিঁপড়াগুলো সাধারণ পিঁপড়ার মতোই দেখতে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না কেন পিঁপড়ার সংখ্যা এত পরিমাণে বাড়ছে। তাদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব সেটিও বুঝতে পারছি না। গ্রামবাসীকে আপাতত বনে গবাদিপশু চড়াতে মানা করা হয়েছে।’
গ্রামবাসীর অভিযোগ, পিঁপড়ার আক্রমণে শুধু গবাদিপশু নয়, ইতোমধ্যে সাপ এবং খরগোশও মারা গেছে।
কীটবিজ্ঞানী ড. প্রণয় বৈদ্য বলেছেন, শত শত পিঁপড়া যে ফরমিক অ্যাসিড ছুড়ে দেয় তা প্রাণীর চোখের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে তারা বিশেষভাবে চোখকে লক্ষ্য করে কি না তা রেকর্ড করা হয়নি। এই অ্যাসিড মানুষের দেহে অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তবে এটি প্রাণঘাতী না-ও হতে পারে।
পোকামাকড়ের এই বিস্তার অঞ্চলটির পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. বৈদ্য জানান, এই পিঁপড়াগুলো প্রথম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস দ্বীপে আক্রমণ করে। তারা প্রথম সেখানকার স্থানীয় পিঁপড়াদের আক্রমণ করে এবং তাদের খাদ্যের উৎস দখল করে নেয়। স্থানীয় পিঁপড়াদের স্থানচ্যুত করে। সেই সঙ্গে দ্বীপের লাখ লাখ লাল কাঁকড়াকে অন্ধ করে মেরে ফেলে।
ড. প্রিয়দর্শন ধর্মরাজন একজন কীটতত্ত্ববিদ। তিনি বলেছেন, এই পিঁপড়ার ফসলের রসচোষক ক্ষুদ্র এক ধরনের পোকা এফিডের সঙ্গে সহজীবী সম্পর্ক রয়েছে। এফিড রস চুষে ফসলের ক্ষতি করে।
ধর্মরাজন বলেছেন, ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পিঁপড়ার আক্রমণ এখন আরও বাড়তে পারে। কারণ যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের হজমক্ষমতা বাড়ে। যার ফলে তারা আরও বেশি খায়। এটি একটি কারণ হতে পারে।
তবে তিনি এও বলেছেন, এটি ধারণামাত্র। এ ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য আমরা পাইনি। আমাদের সংক্রমণের এলাকার আবহাওয়ার ধরন সম্পর্কিত আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং এটি বিশ্লেষণ করতে হবে। তারপরই নিশ্চিত করে বলা যাবে।