এখন থেকে ৭৫ বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। তবে যাওয়ার আগে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে দুটি ভাগে করে দিয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তান।
দেশভাগের পরই শুরু হয় দাঙ্গা। দেড় কোটি মানুষ বাস্তুহারা হন, সহিংসতায় প্রাণ হারান ১০ লাখ। ওই বিভাজনের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান চিরশত্রুতে পরিণত হয়।
১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আর ১৫ আগস্ট ভারতের। উপমহাদেশে বিভাজনের ৭৫ বছর উপলক্ষে এক নিবন্ধে বিবিসি বিশ্লেষণ করেছে পেছনের কারণগুলো। সেটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
বিভাজনের মূল কারণ কী
১৯৪৬ সালে ব্রিটেন ভারতকে স্বাধীনতা দেয়ার ঘোষণা দেয়। দেশটির শাসনকাজ চালানোর সক্ষমতা হারানোর পর তারা যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছিল।
ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত স্বাধীনের তারিখ ঠিক করেন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট।
এ অঞ্চলের ২৫ শতাংশ নাগরিক ছিল মুসলমান, বাকিদের অধিকাংশ হিন্দু। এরপর ছিল শিখ, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
ভারতের দ্য আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিস রিসার্চ কাউন্সিলের অধ্যাপক নাভতেজ পুরেওয়াল বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতের মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজনের জন্য ব্রিটিশরা ধর্মকে বেছে নেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা স্থানীয় নির্বাচনে মুসলিম ও হিন্দু ভোটারদের জন্য আলাদা তালিকা তৈরি করেছিল।
‘মুসলমান রাজনীতিকদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল। একই রকম সংরক্ষিত আসন ছিল হিন্দুদের জন্যও। রাজনীতিতে ধর্ম বড় একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যাটাম হাউস ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের সদস্য ড. গ্যারেথ প্রাইস বলেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা ঘনিয়ে আসার সময় অনেক ভারতীয় মুসলিম ভাবতে শুরু করেন, তারা কীভাবে একটি হিন্দুশাসিত দেশে থাকবেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাই আলাদা একটি মুসলিম দেশের জন্য তারা আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন জোগানো শুরু করেন।’
কংগ্রেস পার্টির স্বাধীনতা-আন্দোলনের নেতা মোহনদাস গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু এমন এক অখণ্ড ভারত চাচ্ছিলেন, যা সমস্ত ধর্মকে বরণ করে নেয়। তবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বাধীনতার অংশ হিসেবে দেশভাগের দাবি তোলেন।
ড. প্রাইস বলেন, ‘অখণ্ড ভারত কীভাবে কাজ করবে সেটা ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যেত। দেশভাগ ছিল দ্রুত ও চটজলদি একটা সমাধান।’
দেশভাগে ক্ষতির পরিমাণ কতটা?
ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করেন।
উপমহাদেশকে তিনি মূলত দুটো বৈশিষ্ট্যে ভাগ করেন:
১. হিন্দু অধ্যুষিত মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল।
২. উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বের দুটি অঞ্চল যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
তবে ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু ও মুসলিমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করত। প্রায় দেড় কোটি লোককে বহু পথ পাড়ি দিয়ে সীমানা অতিক্রম করতে হয়।
১৯৪৬ সালে কলকাতা রায়টের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ কারণেও বহু লোককে ঘরছাড়া হতে হয়। কলকাতার দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ মানুষ মারা পড়েন।
এসওএএস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের অধ্যাপক এলানর নিউবিগিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ডানপন্থি হিন্দু গ্রুপ ও মুসলিম লীগ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেছিল। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো মানুষদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত।’
কমপক্ষে ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ লোক এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রোগশোকে ভুগে মারা যান। হিন্দু ও মুসলিম হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ, অপহরণ বা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত পাকিস্তান ও ভারতের মানচিত্র (বাঁয়ে), চূড়ান্ত কার্যকর হওয়া মানচিত্র । ছবি কোলাজ: নিউজবাংলা
বিভাজনের চূড়ান্ত ফল কী
দেশভাগের পর থেকে কাশ্মীর প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৫ সালে দুই দেশ যুদ্ধে জড়ায়। ১৯৯৯ সালে কারগিলেও লড়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বর্তমানে দেশ দুটি কাশ্মীরের দুটি ভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করে।
বর্তমানে পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম হিন্দু। ড. প্রাইস বলেন, ‘পাকিস্তান দিনে দিনে আরও বেশি ইসলামপন্থি হয়ে উঠছে। এর মূল কারণ হচ্ছে জনসংখ্যার বড় একটা অংশ মুসলমান এবং খুব বেশি হিন্দু দেশটিতে বাস করেন না। একইভাবে ভারত এখন হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে।’
ড. নিউবিগিন বলেন, ‘ভারত ভাগের পরবর্তী আখ্যানটি দুঃখজনক। দুই দেশেই শক্তিশালী ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমে এসেছে এবং তারা আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে আছে।’
অধ্যাপক পুরেওয়াল যোগ করেন, ‘১৯৪৭ সালে হয়তো অবিভক্ত ভারত রাখা সম্ভব ছিল। হয়তো কয়েকটি রাজ্যের ফেডারেশন হিসেবে একে গঠন করা যেত, যেখানে কয়েকটি রাজ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকতেন। তবে গান্ধী ও নেহরু দুজনেই কেন্দ্রশাসিত অবিভক্ত একটি রাষ্ট্রের ধারণায় অটল ছিলেন। তারা ভাবেননি যে সংখ্যালঘু মুসলিমরা কীভাবে সে দেশে থাকবেন।’