তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেখানে চীনের হামলার দরকার নেই বলে মনে করছেন চীন ও আমেরিকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছে, চীন চাইলেই স্বশাসিত দ্বীপটিকে অবরুদ্ধ করে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। আমেরিকান রাজনীতিক পেলোসির তাইপে সফরের প্রতিক্রিয়ায় তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সামরিক মহড়া এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) মহড়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার। ছয়টি অঞ্চলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চলছে মহড়া। এই অঞ্চলগুলো মূলত তাইওয়ানকে ঘিরে রেখেছে। চীনা বাহিনী লাইভ-ফায়ার ড্রিল এবং মিসাইল উৎক্ষেপণ করায় এসব অঞ্চলে ইতোমধ্যে বেসামরিক জাহাজ এবং বিমান চলাচল সীমিত হয়ে গেছে।
পিএলএ ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেং জিয়াংকিং বলেন, ‘চীন কীভাবে তাইওয়ানের বন্দরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে, সেখানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে এবং তাইওয়ানের সাহায্যে আসতে পারে এমন বিদেশি বাহিনীর প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে পারে, এসব দেখানোর জন্যই নির্দিষ্ট ছয়টি এলাকা বেছে নেয়া হয়েছে।’
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক তাইওয়ানকে তার অঞ্চল হিসাবে দেখে। যদিও অঞ্চলটিকে কখনই নিয়ন্ত্রণ করেনি বেইজিং। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানকে একত্রিত করা চীনা নীতির একটি ভিত্তি। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দ্বীপটিকে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আনতে শক্তি প্রয়োগকেও অস্বীকার করেননি।
উত্তরাঞ্চলীয় মহড়া এলাকাগুলো সফলভাবে তাইওয়ানকে ওকিনাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বলে দাবি করেন মেং।
জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই যথেষ্ট সামরিক সম্পদ রয়েছে তাইওয়ানে। দ্বীপের দক্ষিণের বাশি চ্যানেলকে যে চীন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত।
মেং বলেন, ‘দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশ এবং বের করার একমাত্র উপায় এই অঞ্চল। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলে বিদেশি যুদ্ধজাহাজকে তাইওয়ানের জলসীমা থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে চীনা বাহিনী।’
পরিকল্পিত এক দীর্ঘ মহড়ার ইঙ্গিত
যুক্তরাষ্ট্রের হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি দ্বীপের গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দেখানোর জন্য গত সপ্তাহে তাইপেই সফর করে বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করার পর, মহড়াটি শুরু হয়েছিল।
জাহাজ এবং জেট দিয়ে তাইওয়ানের চারপাশে সমুদ্র এবং আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চীনা সেনারা। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, রোববার তাইওয়ান প্রণালিতে ৮০টির মতো চীনা যুদ্ধবিমান এবং জাহাজ শনাক্ত হয়েছে।
আগেও মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ান-নিয়ন্ত্রিত দ্বীপগুলো লক্ষ্য করে রকেট ছুড়েছিল চীন। ব্যবহার হয়েছে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইলও। যেগুলো কিছু তাইওয়ানের ওপর দিয়ে দ্বীপের পূর্ব সাগরে পড়েছিল। জাপানের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে পাঁচটি মিসাইল আঘাত হানার ঘটনা তাইওয়ানের মূল সমর্থকদের পাশাপাশি তাইপেই সরকারের কাছে একটি বার্তা৷
স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহকারী ফেলো এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক সেনা জেনারেল মিক রায়ান বলেন, ‘চীনের মহড়ার এলাকার মানচিত্র স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে তাইওয়ানকে কৌশলগতভাবে আতঙ্কে রাখার চেষ্টায় আছে চীন।
মহড়ার কারণে বাণিজ্যিক জাহাজ এবং বিমানকে নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা করেছিল চীন। এতে বাধ্য হয়ে বিকল্প রুটের ব্যবস্থা করেছে শিপার এবং এয়ারলাইনগুলো।
হাওয়াইয়ের ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের অপারেশনের সাবেক পরিচালক কার্ল শুস্টার বলেন, ‘যে ছয়টি অঞ্চল অবরোধ রেখেছে চীন, সেগুলোর একটির দখলের মধ্য দিয়ে দ্বীপটিকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ শুরু করতে পারে বেইজিং।
‘মহড়াটি দেখিয়েছে যে একটি সংঘাতে অবরোধের জন্য উপকূলে অবিরাম নৌ উপস্থিতির প্রয়োজন হয় না। বরং সমুদ্রপথ অবরোধ করে বিমান ও মিসাইলের হুমকি দিয়ে শিপিং এবং এয়ার ট্রাফিককে প্রতিহত করা যেতে পারে।’
শুস্টারের মতে, বেইজিং প্রথমে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করবে। তারপর তাইপেইয়ের রাজনৈতিক ইচ্ছা ভঙ্গের আশায় বিমান ও মিসাইল হামলার দিকে ঝুঁকবে।
এরপর কী ঘটবে?
মহড়াগুলো পিএলএর প্রশিক্ষণ ক্যালেন্ডারে মানসম্পন্ন সামরিক মহড়ার সঙ্গে মিলে যায় বলে জানিয়েছেন শুস্টার।
তিনি বলেন, ‘মহড়ার পরিধি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জটিলতা চীনের কয়েক মাসের পরিকল্পনাকে প্রতিফলিত করে। মহড়াটি চীনের সম্প্রসারিত সামরিক মহড়া, যা তাইওয়ান-ভীতি প্রদর্শন অভিযানের সবশেষ অবস্থানকে নির্দেশ করে।’
শুস্টারের ধারণা, তাইওয়ানের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে চীন। দ্বীপের উত্তরে আরও মহড়া দিয়ে জাপানকেও একটি বার্তা পাঠাতে পারে বেইজিং।
শুস্টার বলেন, ‘দক্ষিণ চীন সাগরের ১.৩ মিলিয়ন বর্গমাইলজুড়ে নতুন মহড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই চীন তার সার্বভৌম অঞ্চল দাবি করে। সেখানে বিতর্কিত দ্বীপগুলোতে সামরিক দুর্গ গড়ে তুলেছে বেইজিং।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শত্রুদের আধুনিক চীনা সামরিক শক্তির জানান দিতে এই মহড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল রায়ান টুইটারে লেখেন, ‘সেনা মোতায়েনের চেয়ে বাহিনীর প্রকৃত সক্ষমতার জানান দেয়াটা বেশি কাজের।’
শুস্টার বলেন, ‘এ মহড়ার মাধ্যমে চীন এটাই স্পষ্ট করতে চাইছে, কোনো মূল্যে তারা তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চায়।’