ভয়, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি তীব্র হয়ে উঠেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের। কারণ মঙ্গলবার চার মাসের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে৷
রাজধানী সানার বাসিন্দা সালেহ আহমেদের বয়স ৫০। অন্যদের মতো তিনিও যুদ্ধের একটি নতুন চক্রে প্রবেশের আশঙ্কায় ভুগছেন। তার মতে, যুদ্ধবিরতির মেয়াদ হলো একাধিক অগ্নিপরীক্ষার পুনর্জন্ম।
সালেহ বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হবে, রাস্তা অবরুদ্ধ হবে, জ্বালানি ব্যয়বহুল হবে, মৌলিক জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে উঠবে, বেসামরিক মৃত্যু বাড়বে। এগুলো জীবনকে তিক্ত এবং অসহনীয় করে তোলে।’
জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিটি ইয়েমেনের সাত বছরের যুদ্ধের মধ্যে দীর্ঘতম অবকাশ। এটি ইয়েমেনের বেশির ভাগ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণকারী ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সমর্থিত সরকারকে আটকে রাখছে। এই সরকার আবার আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত।
যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থাকলেও, চার মাস এটি টিকে ছিল। মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইয়েমেনে জাতিসংঘের দূত হ্যান্স গ্রুন্ডবার্গ এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত টিম লেন্ডারকিং এটি বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছেন।
গত সপ্তাহে গ্রুন্ডবার্গ দক্ষিণের বন্দর শহর এডেন ভ্রমণ করেন। সেখানে ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন জাতিসংঘের এ দূত। গ্রুন্ডবার্গ আলোচনা করেন সৌদি ও ওমানের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও। অন্যদিকে, একই মিশন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লেন্ডারকিং রিয়াদ এবং জর্ডানের রাজধানী আম্মান চষে বেড়াচ্ছেন।
আহমেদ একজন মিনিবাসচালক। যুদ্ধবিরতিকে ‘ভালো দিন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির আগে আমার গাড়িতে পেট্রল ভর্তি করার জন্য গ্যাস স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। এখন যেকোনো সময় ট্যাংকি পূরণ করতে পারি। আমার পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে পারি। যুদ্ধবিরতিতে আমার অবস্থা ভালো হয়েছে।’
জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধবিরতির ফলে মানবিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পেট্রল স্টেশনগুলোর সামনে গাড়ির লম্বা লাইন কমেছে। ইয়েমেনিরা সারা দেশে আরও সহজে ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছে।
হুথি-নিয়ন্ত্রিত সানার ২৪ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ফাতিমা আমরি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর ব্যর্থতা কূটনীতির জন্য একটি হতাশাজনক ধাক্কা। মেয়াদ না বাড়লে ইয়েমেনে মানবাধিকারের ওপর হামলা হবে।’
‘যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে চলাচলের স্বাধীনতাসহ অনেক অধিকার হারাব। সংঘাত দেশকে জেলখানায় পরিণত করেছে। যুদ্ধবিরতি সেই কারাগারকে আংশিকভাবে খুলতে সাহায্য করেছিল। যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেলে এটি আবার বন্ধ হয়ে যাবে।
যদিও বেশির ভাগ ইয়েমেনিরা যুদ্ধবিরতির বাস্তব উপকারিতা স্বীকার করে। তবে যুদ্ধের চেয়ে বর্তমান বিরতি দীর্ঘস্থায়ী দেশকে শান্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং দেশের দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারে এ কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না এমন সংখ্যাও কম না।
ইয়েমেনি সাংবাদিক মোহাম্মদ আল-সামেই বলেন, এমন কোনো আভাস নেই যে যুদ্ধরত পক্ষগুলো শিগগিরই যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রস্তুত। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে বারবার সংঘটিত লঙ্ঘনগুলো ইয়েমেনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের। এটা হুথি গোষ্ঠীর যুদ্ধপ্রবণ মনোভাব প্রদর্শন করে।’
যদিও যুদ্ধবিরতি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য দারুণ স্বস্তি এনেছে, তবুও এটি বিবদমানদের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করেনি।
আল-সামেই বলেন, ‘ইয়েমেনি সরকার এবং হুথি গোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার স্তর পুরো যুদ্ধবিরতিতে উন্নত হয়নি। উভয় পক্ষের প্রায় সমান সামরিক শক্তি থাকায়, ইয়েমেনে অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়।
সংঘাতের জটিলতা বিবেচনায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের সদস্য আমর আল-বিধ ইয়েমেনের আন্তর্জাতিক সরকারের মিত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি দক্ষিণ ইয়েমেনে স্ব-শাসনের জন্য চাপ দিচ্ছেন। গত সপ্তাহে লন্ডন সফরের সময় সাংবাদিকদের আমর বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিরতি বাড়ানো হতে পারে।
‘কিন্তু একই সময়ে যুদ্ধ আসছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। আমি মনে করি হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না হওয়া বোকামি হবে।’