ব্লুমবার্গের সার্বভৌম ঋণ দুর্বলতা র্যাংকিংয়ে পাকিস্তান এখন ৪ নম্বরে। এটি একটি দেশের ডিফল্ট ঝুঁকির যৌগিক পরিমাপ। পাকিস্তানের ঋণ জিডিপির ৭১ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান কি সামনে শ্রীলঙ্কা হবে? হংকংয়ের সাউথ চাইনা মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করেছেন সারোয়ার প্রতীক।
যদিও উদ্বেগজনক অর্থনীতি পাকিস্তানের খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, এপ্রিলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ভগ্ন রাজনৈতিক পরিবেশ সেই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এজেন্ডার মূল বিষয়, তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠোর শর্তে নির্দেশিত হলেও।
একটি জোট সরকার বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যসহ অন্তত এক ডজন বিরোধী দল নিয়ে গঠিত। পার্লামেন্টে তারা সামান্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করে, যেখানে তারা ভয়ংকর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত।
একটি দুর্বল সরকার কি সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের তরঙ্গের মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে? সুতরাং পাকিস্তানের প্রকৃত ডিফল্ট ঝুঁকি অর্থনৈতিক ফ্রন্টের পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই বেশি।
শ্রীলঙ্কা এপ্রিলে ৫১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হয়েছে, তা শিক্ষামূলক। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বিক্ষোভকারীদের তোলা ঝড় অর্থনৈতিক মন্দা থামাতে সরকারের ব্যর্থতার সঙ্গে জনসাধারণের হতাশাকে প্রতিফলিত করেছে; যা জ্বালানি, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তানেও একই দশা। দেশটির ঋণের বোঝা বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতনের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে; চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়ছে এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে জ্বালানি ও পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে দেশটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং গভীরতর রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হবে।
মার্চের শেষে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ও দায় বেড়েছে ১২৮ বিলিয়ন ডলার। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিষেবার জন্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের ২১ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে ইসলামাবাদকে।
আইএফএমের সঙ্গে ১৩ জুলাই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অর্থনৈতিক চুক্তি দেশটির জন্য একটি জীবনরেখা প্রদান করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তার পূর্বসূরির হাতে কার্যকর জ্বালানি ভর্তুকি ফিরিয়ে দিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে দাম বাড়িয়েছিলেন। এপ্রিলে যখন খান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, তখন পেট্রলের দাম ছিল লিটারপ্রতি প্রায় ১৫০ টাকা; এটি এখন ২৫০-এর কাছাকাছি।
উল্লেখযোগ্য এই বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে। এতে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য খাবারের দাম বেড়েছে। পাকিস্তানিরা ২১ দশমিক ৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির নিচে অবস্থান করছে এবং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ঘন ঘন বিদ্যুতের ব্ল্যাকআউটের শিকার হচ্ছে।
সরকার আইএমএফের নির্দেশে অর্থনীতি পরিচালনা করছে। তবে আগামী বছরের আগস্টে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘অজনপ্রিয়’ সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। দারিদ্র্য, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে থাকা মানুষ ক্রমেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
এ পরিস্থিতি ইমরান খানকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে রাখছে। তারা দাবি করছে, সরকার দরিদ্রদের কথা চিন্তা না করেই আইএমএফের দাবিগুলো নিঃশব্দে মেনে নিচ্ছে। সরকারকে ‘দুর্নীতিবাজ এবং আমদানি করা’ আখ্যা দিয়ে তিনি নতুন নির্বাচনের দাবি করছেন।
ইমরান খানকে গত ১০ এপ্রিল অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে অপসারণ করা হয়েছিল। তবুও তিনি দাবি করেন, এটি বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ; যা যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ওপর নির্ভরশীল সরকারকে পতনের জন্য তৈরি করেছিল। এখনও জনসভায় বিদেশি ষড়যন্ত্রের বর্ণনা দিচ্ছেন ইমরান খান।
ইমরান খানের দাবির বিরোধিতা করে ১২টির বেশি রাজনৈতিক দল (ছোট এবং মূলধারা উভয়ই) নিরাপত্তা সংস্থায় যোগ দিয়েছে। তবুও জনগণ তার (ইমরান খান) অভিযোগ বিশ্বাস করছে, ‘আমদানি করা’ সরকার আসলে কী করছে, তা দেখছে না।
শিগগিরই নতুন নির্বাচন ঘোষণা না হলে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে হাজার হাজার লোকের পদযাত্রার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইমরান খান। আর এই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তাপের কারণে পাকিস্তানের খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা খুব প্রয়োজনীয় বহুপাক্ষিক সহায়তা আটকে রাখতে পারে, সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। রাজনীতি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এসব কর্মসূচিকে জিম্মি করবে, কারণ শ্রীলঙ্কার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঋণখেলাপি হওয়ার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে পাকিস্তান।