শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন। এতে দেশটি আইনি অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. জায়ামাফতি বিক্রমারাত্নে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান তাকে এমন ক্ষমতা দেয়নি।
এর আগে বুধবার সকালে পলাতক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বাসভবন ঘিরে চলা আন্দোলন ও বিক্ষোভ সামাল দিতে বিক্রমাসিংহের সরকার রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রমাসিংহের এমন সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেয়া হবে।
আন্দোলনকারীদের নেতা কল্পনা মধুভাসিনি বলেন, ‘এমন অবৈধ জরুরি অবস্থার ঘোষণা মেনে নেব না। আমরা গোতাবায়া ও রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা চাইব, তারা এমন জরুরি অবস্থার ঘোষণা থেকে সরে আসুক।’
তিনি আরও বলেন, ‘জরুরি অবস্থার এই ঘোষণা জনগণকে রক্ষার জন্য করা হয়নি। বরং আন্দোলনকারীদের দমনে জারি করা হয়েছে।’
দেশটির সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. জায়ামাফতি বিক্রমারাত্নে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন না। সংবিধান তাকে এমন ক্ষমতা দেয়নি। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে তিনি অন্য একজনকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করতে পারেন। তা না করে তিনি অবৈধ ঘোষণা দিয়েছেন।’
সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার সাংবাদিক স্টেপ ভ্যাসেন জানিয়েছেন, বিক্রমাসিংহের এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশটি আইনিভাবে অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।
ভ্যাসেন বলেন, ‘তারা এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠিপত্র সংবাদমাধ্যমকে দেখায়নি। এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাউকে নিয়োগও দেননি।’
এর আগে বিভিন্ন মাধ্যমে এমন কথা ছড়িয়েছে যে, বিক্রমাসিংহে ক্ষমতা ছাড়ছেন না এবং তিনি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করবেন।
বিক্ষোভে উত্তাল কলম্বো
চরম অর্থনৈতিক সংকটের জন্য দেশটির পলাতক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে দায়ী করে তার পদত্যাগ দাবি করেন হাজারো বিক্ষোভকারী।
তীব্র বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার।
বুধবার সকাল থেকে রাজধানী কলম্বোতে দেশটির পলাতক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকারি বাসভবন ঘিরে রেখে বিক্ষোভ করছে কয়েক হাজার মানুষ।
চরম অর্থনৈতিক সংকটের জন্য গোতাবায়াকে দায়ী করে তার পদত্যাগ দাবি করেন তারা।
বিক্ষোভকারীরা সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা দেশটির পার্লামেন্ট ভবনের দিকে যাত্রা করবে এবং প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন।
এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগও দাবি করেন।
এদিকে, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার মালদ্বীপে আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
কমপক্ষে ১৫০০ বিক্ষোভকারী দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের কার্যালয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ছোড়া টিয়ারগ্যাসের সেলের আঘাতে আহত হয়েছেন অনেকে।
এর আগে, গত ৯ জুলাই অর্থনৈতিক মন্দা ও আন্দোলনের মুখে নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে পদত্যাগ করতে চান বলে জানিয়েছে তার দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া বিভাগ জানিয়েছে, পার্লামেন্টে সর্বদলীয় সরকার গঠন হওয়ার পরই পদত্যাগ করবেন তিনি।
এর আগে বুধবার সকালে বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে মালদ্বীপে যান। বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের আগে দেশ ছাড়েন তিনি।
প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে, তার স্ত্রী, নিরাপত্তারক্ষীসহ চারজন একটি সামরিক উড়োজাহাজে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন বুধবার ভোরে।
মালে বিমানবন্দর পুলিশ জানিয়েছে, মালদ্বীপ বিমানবন্দরে অবতরণের পর কড়া পুলিশি পাহারায় তাদের গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির ইমিগ্রেশন অফিসারদের বাধায় তিনি যেতে পারেননি। আকাশপথে ব্যর্থ হয়ে তিনি নৌবাহিনীর জাহাজে শ্রীলঙ্কা ছাড়ার চেষ্টাও করেন।
৭৪ বছর বয়সী গোতাবায়া রাজপাকসে স্ত্রীসহ দেশটির কলম্বোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে সামরিক ঘাঁটিতে ছিলেন।
তিনি সোমবার রাতে সেখানেই ছিলেন। সেখান থেকেই মঙ্গলবার সকালে তিনি বিমানবন্দরে আসেন।
গোতাবায়া বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে ভিআইপি স্যুটে অপেক্ষা করছিলেন। নিরাপত্তার জন্যই তাকে সেখানে রাখা হয়। এরপর তার পাসপোর্ট সিল মারার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসারদের ভিআইপি স্যুটে যেতে বলা হয়। তারা গোতাবায়ার পাসপোর্টে সিল মারতে অস্বীকার করেন।
গোতাবায়া পরিবার নিয়ে সম্ভবত দুবাই যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য গোতাবায়া ভিসার আবেদন করেছিলেন। তবে তার সে আবেদন নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার এক শীর্ষ কর্র্মকর্তার বরাত দিয়ে শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ডেইলি মিররের প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল গোতাবায়ার। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে একটি আইন মেনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেন। ওই আইনে বিদেশি নাগরিকদের নির্বাচনে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ ছিল।
গোতাবায়ার ছোট ভাই ও দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজপাকসেও গোপনে দেশ ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের বাধার কারণে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সকালে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে গোপনে কলম্বো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালে হাজির হন বাসিল। কিন্তু বিমানবন্দরে থাকা লোকজন তাকে চিনে ফেলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা বিমানবন্দর ঘেরাও করে অবস্থান নেন।
এ পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বাসিলকে ভ্রমণজনিত ক্লিয়ারেন্স দিতে রাজি না হওয়ায় ফিরে যান শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী।
এর আগে গোতাবায়া পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। সোমবারই তিনি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে এরই মধ্যে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছেন।
যদিও যে পদত্যাগপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছেন তার তারিখ দেয়া আছে ১৩ জুলাই, বুধবার।
এরই মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবিবর্ধনে। তিনি বুধবার প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের বিষয়টি জনসমক্ষে জানাবেন।