ইউক্রেনে চলছে রুশ সামরিক অভিযান। যুদ্ধবিরতির কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছে। এদিকে পরাশক্তি চীন-তাইওয়ান দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে। তাইওয়ানের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সামরিক অভিযান শুরু হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বেইজিং।
এমন পরিস্থিতিতে আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এরই মধ্যে চলছে, যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এবং বিশ্বজুড়ে অন্যান্য সংঘাতে কাজ করা ‘উপাদান’ এর প্রমাণ।
জেসুইট মিডিয়া আউটলেটে এক সাক্ষাৎকারে পোপ বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমার মনে হয়েছিল যে আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের খণ্ড খণ্ড লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছি। আজ, আমার জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনের লড়াই যখন আমাদের সংবেদনশীলতাকে আরও বেশি আঘাত করছে, একই সময়ে উত্তর নাইজেরিয়া ও মিয়ানমারের মতো জায়গায়ও যুদ্ধ চলছে এবং কেউ পাত্তা দেয় না।’
পোপ ফ্রান্সিসের মতে, ‘বিশ্ব’ যুদ্ধে লিপ্ত এবং যার পেছনে রয়েছে অস্ত্র ব্যবসা।
তবে পোপ ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কঠোর সমালোচনা করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন।
রাশিয়ার সামরিক অভিযান প্রতিরোধে ইউক্রেনীয় সেনাদের বীরত্বের প্রশংসা করলেও তিনি বলেন, আমাদের চোখের সামনে বিশ্বযুদ্ধ, বৈশ্বিক স্বার্থ, অস্ত্র বিক্রি ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যা বীর জনগণকে শহীদ করছে।
পোপ ফ্রান্সিস আরও সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ইউক্রেনের অনেক পশ্চিমা সমর্থক লড়াইয়ের শুরুর দিকে ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়ে আসা নারী ও শিশুদের জন্য ‘তাদের হৃদয় খুলে’ দেওয়ার পর এখন সেই সমর্থন এরই মধ্যে শীতল হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এই নারীদের (শরণার্থীদের) দেখভাল করবে কে? এরই মধ্যে শকুন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্যের মতোই ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে কি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? যুক্তরাজ্যের এক্সপ্রেস ইউকে পত্রিকা বিশ্বযুদ্ধের ট্যাগও চালু করেছে।
কেমব্রিজ ডিকশনারিতে বিশ্বযুদ্ধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিশ্বযুদ্ধ সেটাই, যখন অনেক দেশ বিশাল সামরিক বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া কলিন্স ডিকশনারিতেও বিশ্বযুদ্ধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সব দেশ যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, সেটাই বিশ্বযুদ্ধ।
বিশ্বযুদ্ধ বলতে আমরা বুঝি, যে যুদ্ধে পুরো বিশ্বের সব দেশ কিংবা অধিকাংশ দেশ জড়িয়ে পড়ে। এখন পর্যন্ত এমন বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে দুটি। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেন ও রাশিয়ার চলমান যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধ বলার সুযোগ নেই। যদিও দুই দেশের কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্ন একটি বিষয় রয়েছে। বিশ্বের প্রত্যক্ষ করা দুটি বিশ্বযুদ্ধই হয়েছে ইউরোপে এবং এর শুরুটা হয়েছে দুই দেশের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের সস্ত্রীক খুনের ঘটনায় অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি যুদ্ধ শুরু করে, যা পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময়ও। জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ একসময় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়।
আগের দুটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। পরিস্থিতি দেশটিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেক্সিকোগামী আন্তর্জাতিক জাহাজে জার্মান হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়।
ফলে নিরপেক্ষতা থেকে বেরিয়ে এসে ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। একই ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও। যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে জার্মানির মিত্র জাপানের আক্রমণের ফলে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রেও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরই মধ্যে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একে অপরকে গুলি করে, তবে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তাই পশ্চিমা সামরিক জোটও রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘাতে যুক্ত হতে চাইছে না।
আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি যে পারমাণবিক যুদ্ধ, তাও বেশ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ল্যাভরভ।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ মোটেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়। তবে ইউক্রেনে রুশ হামলা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু? তা এখনও বলার সময় আসেনি।