পাকিস্তানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম। বিদ্যুতের দামেও দিয়েছে লাফ।
করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশটিতে নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই আকাশচুম্বী। নতুন এই সিদ্ধান্ত পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে বলা ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ প্রয়োজনে নিজের গায়ের জামা বিক্রি করে দেশবাসীকে কম দামে আটা খাওয়ানোর ঘোষণার রেশ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার পেট্রল ও ডিজেলের দাম ৩০ রুপি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানান নতুন অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল। মধ্যরাত থেকেই কার্যকর হয় নতুন দাম। এক সপ্তাহ আগে জ্বালানি তেলের দাম একই পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল।
সবশেষ বর্ধিত দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ঠেকেছে ২০৯ দশমিক ৪৬ রুপিতে। ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম হয়েছে ২০৪ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে পেট্রলের দাম হয় ১০৫ টাকার আশপাশে আর ডিজেলের দর ১০০ টাকার বেশি।
ন্যাশনাল ইলেকট্রিক পাওয়ার রেগুলেটরি অথরিটি (নেপ্রা) বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৭ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর মানে ইউনিটপ্রতি বেড়েছে ৭ দশমিক ৯ রুপি।
বিবৃতিতে নেপ্রা জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টার জন্য গড়ে ২৪ দশমিক ৮২ রুপি দিতে হবে।
দেশটির প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডন বলছে, আগেরবার ডিজেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন ভাড়া ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছিল। নতুন সিদ্ধান্তে ভাড়া আরও বাড়ানোর চিন্তা চলছে।
করাচি গুডস ক্যারিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (কেজিসিএ) সভাপতি রানা মোহাম্মদ আসলাম বলেন, ‘ডিজেলের দামে আরও একটি ধাক্কা এসেছে। আমরা আলোচনা শুরু করেছি। শিগগিরই আরও ২৫-৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হব।
‘করাচি এবং ফয়সালাবাদ-লাহোরের মধ্যে দ্বিমুখী ট্রেলার চলাচলের ভাড়া এখন ১ লাখ ৭০ হাজার রুপি, কয়েক মাস আগেও যা ছিল ১ লাখ রুপি। নতুন করে ভাড়া বাড়ানো হলে তা ২ লাখ রুপিতে ঠেকবে।’
কেজিসিএ সভাপতি আরও বলেন, ‘কোনো বেসরকারি বা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আমাদের পরিবহন খরচ নির্ধারিত না। আমরা একটি উন্মুক্ত বাজার পরিবেশে কাজ করি। করাচিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দিনে গড়ে অন্তত ১৫ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি আসা-যাওয়া করে।
‘ইঞ্জিন তেল, খুচরা যন্ত্রাংশ, টায়ার, রিম এসবের মতো অন্যান্য ব্যয়ের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে পণ্য পরিবহন পরিচালকরা তাদের গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনছেন।’
অল পাকিস্তান অয়েল ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এপিওটিওএ) চেয়ারম্যান ইকবাল জাঙ্গিরি বলছেন, ‘পেট্রোলিয়ামের দামের ওঠানামায় গুরুতর পরিবর্তন আসে না। কারণ স্টেকহোল্ডার এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হয়।
‘তেলের খরচ দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। পেট্রোলিয়ামের দামের উত্থান-পতন অনুযায়ী পরিবহন খরচ সমন্বয় করা হয়। আসলে তেল ট্যাংকার মালিকদের পরিবর্তে পেট্রোলিয়ামের দাম বৃদ্ধিতে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায় ভোক্তারা।’
শহুরে শ্রেণির ওপর প্রভাব
কালেক্টিভ ফর সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ ডিরেক্টর আসাদ সাঈদ বলেন, ‘পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বৃদ্ধি মূলত শহুরে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলবে। পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। দুধ ও রুটি থেকে শুরু করে শাকসবজি ও ফলের দামও বাড়বে।
গ্রামীণ জনসংখ্যাকে ডিজেলচালিত নলকূপের জন্য আরও বেশি ব্যয় করতে হবে। তবে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় শহুরেদের মতো বাড়বে না।’
জ্বালানি ভর্তুকি অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে আসাদ সাঈদ বলেন, ‘সরকারের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। এপ্রিলে ক্ষমতায় আসার দিন থেকেই সরকারের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় জ্বালানির দামের সমন্বয় করা।’
সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ সাজিদ আমিন জাভেদ বলেন, ‘এমন মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। তবে কোনো বিকল্প তো ছিল না। যদি দাম না বাড়ানো হয়, তবে পাকিস্তান আইএমএফ থেকে ছিটকে যেত।
‘বিগত সরকারের বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী। প্রয়োজনের আগেই তারা ভর্তুকি চালু করেছিল। মূল্যবৃদ্ধিতে সময় নিয়ে বর্তমান সরকারও ভুল করছে। সরকারের উচিত অনুৎপাদনশীল পেট্রল ভর্তুকি পুরোপুরি বাদ দেয়া। কারণ এটি ধরে রাখার সামর্থ্য এখন নেই।’
জাভেদ আরও বলেন, ‘যাদের সহায়তা প্রয়োজন, তাদের জন্য ত্রাণ প্যাকেজের সুযোগ ও সময়কাল বাড়ানো দরকার। আইএমএফের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তাই ভর্তুকি প্রত্যাহার করার মাধ্যমে সঞ্চয়কৃত অর্থের একটি অংশ এ ধরনের উদ্যোগে ব্যয় করা যেতে পারে।
‘এ ছাড়া সরকারকে মজুতদারি ও মুনাফাখোর দমন করতে হবে। জেলা মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিকে এ কাজে যুক্ত করতে হবে। আয়কর বাড়াতে হবে। একযোগে এসব পদক্ষেপ নেয়া গেলে মুদ্রাস্ফীতি চাপ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।’
ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। করাচি চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (কেসিসিআই) সভাপতি মুহাম্মদ ইদ্রিস বলছেন, ‘বিদ্যুতের শুল্ক বৃদ্ধি শিল্প খাতের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হবে। এ পদক্ষেপে সব ধরেনর গৃহস্থালি পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবে।
‘এ সিদ্ধান্তটি নেপ্রার (ন্যাশনাল ইলেকট্রিক পাওয়ার রেগুলেটরি অথরিটি) নিয়ম ও প্রবিধান লঙ্ঘন করেছে। কারণ গণশুনানির পরেই শুল্ক নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত এটি হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে নেপ্রার বেআইনি কর্মকাণ্ডের নোটিশ নিতে এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন কেসিসিআই সভাপতি।