ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পশ্চিমারা ইউক্রেনীয় সেনাদের ব্যাপক সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে। অস্ত্র সরবরাহ করে ইউক্রেন পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য পশ্চিমাদেরই দায়ী করছে ক্রেমলিন।
এমন পরিস্থিতিতে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স নিউজ এজেন্সি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, মস্কোর উত্তর-পূর্বে ইভানোভা প্রদেশে রাশিয়ার পরমাণু বাহিনী মহড়া চালাচ্ছে।
পরমাণু বাহিনীর প্রায় ১ হাজার সেনা এই মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। ১০০টিরও বেশি সামরিক যান ও আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ইয়ারসও মহড়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার রকেট আর্টিলারি সিস্টেম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অস্ত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার অনেক ভেতরেও হামলা চালাতে সক্ষম হবে ইউক্রেনের সেনারা।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, ন্যাটো ও রাশিয়ার যুদ্ধ চান না তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইউক্রেনের অভ্যন্তরে অগ্রসরমান রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে এসব দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে এই অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের এমএলআরএস রকেট দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের শুরুর দিকেই পরমাণু বাহিনীকে ‘বিশেষ’ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুতিনের এ বক্তব্য আসলে অন্য দেশগুলোর প্রতি সতর্কবার্তা। এর মানে যুদ্ধে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের আকাঙ্ক্ষা নয়।
এমন বিশ্ব বাস্তবতায় প্রশ্ন আসে, আসলে রাশিয়ার হাতে কয়টি পরমাণু বোমা রয়েছে।
কোন দেশে কতটি পরমাণু অস্ত্র আছে, সে তথ্যগুলো আনুমানিক। ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার কাছে আছে ৫ হাজার ৯৭৭টি পরমাণু ওয়ারহেড। ওয়ারহেড হলো পরমাণু অস্ত্রের অগ্রভাগ, যেটা পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার এসব ওয়ারহেডের মধ্যে প্রায় দেড় হাজারকে বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশটির কাছে থাকা বাকি সাড়ে চার হাজারের মতো অস্ত্র কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র হিসেবে পরিচিত।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট, যা দিয়ে অনেক দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়। এই অস্ত্রগুলো পরমাণু যুদ্ধে ব্যবহার হয়।
রাশিয়ার হাতে ব্যবহার উপযোগী পারমাণবিক বোমা আছে সাড়ে চার হাজার
রাশিয়ার হাতে থাকা বাকি অস্ত্রগুলো ছোট, কম ধ্বংসাত্মক পরমাণু অস্ত্র। এগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে স্বল্পপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে কিংবা সমুদ্রে ব্যবহার করার উপযোগী। এ ছাড়া সাবমেরিন থেকেও রাশিয়ার আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সক্ষমতা রয়েছে।
ইউক্রেন পরিস্থিতিতে পারমাণবিক যুদ্ধ কতটা বাস্তব?
ইউক্রেনে রুশ বাহিনী কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে, এমন দাবি পশ্চিমাদের। এদিকে ইউক্রেনকে সহায়তায় ন্যাটোভুক্ত দেশ ট্যাংকের মতো আক্রমণাত্মক অস্ত্র সরবরাহ করছে।
যদিও সরাসরি ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ায়নি, এরপরও ইউক্রেনকে অস্ত্র দেয়ার বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না রাশিয়া। এমন অবস্থায় যে কৌশলগত পরমাণু বোমা ব্যবহারকে একসময় অসম্ভব ভাবা হতো, তার সম্ভাবনা এখন বাড়ছে।
রাশিয়ার কৌশলগত পরমাণু বাহিনী
১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রগুলো আর কৌশলগত চিন্তার অংশ নয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা ক্রমে বাড়ছে।
১৯৬২ সালে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এখন প্রায় ৫০ বছর পর এসে আবারও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান পারমাণবিক সংঘাতের বিষয়টি আবারও সামনে নিয়ে আসছে।
রাশিয়ার পারমাণবিক হামলায় পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া কী হবে?
রাশিয়া যদি ইউক্রেনে সীমিত পরিসরেও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে, তাতে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? তা বলা মুশকিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, রাশিয়া যদি পারমাণবিক, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্রের হামলা চালায়, যুক্তরাষ্ট্র চুপ করে বসে থাকবে না।
যুদ্ধের সময় একমাত্র হিরোশিমা ও নাগাসাকিতেই পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়নি। এদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে ওয়ারশোতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ওয়ারশো মেমোরেন্ডাম নামে পরিচিত।
যদিও সেই চুক্তি পশ্চিমারাই লঙ্ঘন করেছে ও পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ব্লকের অনেকেই এখন ন্যাটো সদস্য। এমনকি ইউক্রেনের সঙ্গে প্রাথমিক বিরোধও ন্যাটোর সদস্য হওয়া নিয়েই।
এখন প্রশ্ন হলো ইউক্রেনকে পরাজিত করতে পুতিন কী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসবেন?