তাজমহলের বন্ধ ২২টি ঘরের দরজা খোলা নিয়ে এক বিজেপি নেতার দাখিল করা আবেদন পত্রপাঠ খারিজ করে দিলো এলাহাবাদ হাইকোর্ট। আর শুধু আবেদন খারিজ করাই নয়, আবেদনকারীর কঠোর সমালোচনা করলেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ।
বৃহস্পতিবার আবেদনের শুনানির সময় আদালত বলেছে, জনস্বার্থবাহী আবেদন বা পিআইএল ব্যবস্থাকে উপহাসের বিষয় করে তুলবেন না।
তাজমহলের ২২টি তালাবদ্ধ কক্ষের পিছনে ‘সত্যের সন্ধান’ করার জন্য পিটিশনটি গত সপ্তাহে হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চের সামনে দাখিল করা হয়েছিল বিজেপির অযোধ্যা ইউনিটের মিডিয়া ইনচার্জ রজনীশ সিংয়ের পক্ষে।
পিটিশনে কিছু ইতিহাসবিদ ও হিন্দু গোষ্ঠীর দাবি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সমাধিটি আসলে একটি পুরানো শিব মন্দির। পিটিশনে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়াকে (এএসআই) তালাবদ্ধ কক্ষগুলো পরীক্ষা করার জন্য এবং জনসাধারণের কাছে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে।
রজনীশ সিং বলেন, দাবি তাজমহলকে মন্দির বানানোর নয়, সামাজিক সম্প্রীতির স্বার্থে বিষয়টির সত্যতা প্রকাশ করার। তিনি বলেন, এই ধরনের বিতর্কের অবসানের একমাত্র উপায় হলো বন্ধ দরজা খুলে পরীক্ষা করা।
বৃহস্পতিবার শুনানি শুরু হওয়ার পর বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় এবং সুভাষ বিদ্যার্থী আবেদনকারীকে প্রশ্ন করেছিলেন তার আবেদন কী?
আবেদনকারী বলেন, তিনি চান আদালত আদেশের একটি রিট জারি করুক। তখন আদালত বলে, ‘আপনি আমাদের কাছ থেকে কী রায় চান? তাজমহল কে নির্মাণ করেন, তার সন্ধান? ঐতিহাসিক তথ্যে যাবেন না... অধিকার লঙ্ঘিত হলেই নিম্ন আদালতের প্রতি উচ্চ আদালতের হুকুমনামা জারি করা যেতে পারে। আপনার কোন অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে ?’
আবেদনকারী বলেন, তিনি ইস্যুটির একেবারে গোড়ায় যাওয়ার জন্য একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করার জন্য বলছেন এবং তাজমহল সম্পর্কে ‘সত্য’ প্রকাশ হওয়া দরকার বলে ২২টি কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার দাবি করছেন। নাগরিকদের জানতে হবে কেন স্মৃতিস্তম্ভের একাধিক কক্ষ ‘নিরাপত্তার কারণে’ তালাবদ্ধ করা হয়েছে।
আদালত কড়া জবাব দিয়ে বলে, ‘আপনি কার কাছ থেকে তথ্য চাইছেন? আপনি যদি সন্তুষ্ট না হন যে নিরাপত্তার কারণে কক্ষগুলি বন্ধ করা হয়েছে, তাহলে সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে আইনের প্রতিকার ব্যবহার করুন। আগে কিছু গবেষণা করুন– এমএ, পিএইচডি করুন, কোথাও নিজেকে নথিভুক্ত করুন। পিআইএল ব্যবহার করে একটা ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।’
একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে একে হিন্দুদের মন্দির বলে আসছে। কেউ একে শিবমন্দির বলে, আবার কেউ ‘তেজো মহালয়া’ বলে। তাজমহলের যে ২২টি কক্ষের জন্য পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল, তা কয়েক দশক ধরে বন্ধ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকরা বলছেন, তাজমহলের মূল সমাধি ও জুঁই তলার নিচে ২২টি কক্ষ রয়েছে, যেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, মুঘল আমল থেকে এসব কক্ষ বন্ধ রয়েছে।
শেষবার এই কক্ষগুলি ১৯৩৪ সালে খোলা হয়েছিল। তারপর এখানে শুধু পরিদর্শন করা হয়। এরপর থেকে সেগুলো বন্ধ রয়েছে। তাজমহলে, জুঁই তলায় যমুনার তীরে দুটি ধাপ রয়েছে। ওপরে লোহার জাল বসিয়ে এসব সিঁড়ি বন্ধ করা হয়েছে। কথিত আছে, ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে এখানে যাওয়ার রাস্তা থাকলেও পরে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তাজমহলে শিবমন্দির নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে। আগে তেজোময় বা তেজোমহালয় নামে একটি মহাদেবের মন্দির ছিল। অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন, মোগল সম্রাট শাহজাহান মন্দির ভেঙে তার জায়গায় তাজমহল তৈরি করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাসবিদ পুরুষোত্তম নাগেশ ওক-এর বই ‘দ্য ট্রু স্টোরি অব তাজ’ বের হওয়ার পর থেকে তাজমহল বা তেজো মহালয়া বিতর্ক শুরু হয়। ওক তার বইতে তাজমহলের আগে সেখানে একটি শিব মন্দির থাকা নিয়ে অনেক দাবি করেছেন। ওই বইতে রাজা জয় সিংয়ের কথা বলা হয়েছে। ওই সময় তাজমহলে গণেশ, পদ্মফুল ও সাপের আকৃতির অনেক মূর্তি দেখা গেছে বলে দাবি করা হয়।
পুরুষোত্তম নাগেশ ওক ভারতের একজন সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদ ছিলেন। তার প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল খ্রিস্টান এবং ইসলাম উভয়ই হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভূত। ভ্যাটিকান সিটি, কাবা, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে এবং তাজমহল একসময় শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হিন্দু মন্দির ছিল এবং পোপ পদটি ছিল মূলত একটি বৈদিক যাজকত্ব।
এলাহাবাদ হাইকোর্টে দাখিল করা পিটিশনের আবেদনকারী রজনীশ সিংয়ের আইনজীবী রুদ্র বিক্রম সিংয়েরও তাজমহল নিয়ে ভিন্ন যুক্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ১৬০০ সালে ভারতে আসা লোকেরা তাদের ভ্রমণের বর্ণনায় তাজমহলের জায়গায় মানসিংহের প্রাসাদের উল্লেখ করেছিলেন।
এরপর ১৬৫৩ সালে তাজমহল নির্মিত হয়। এরই মধ্যে একটি চিঠিও বার বার আলোচনায় উঠে এসেছে। ১৬৫১ সালে লেখা সেই চিঠিতে আওরঙ্গজেব লেখেন যে ‘আম্মির সমাধি’ মেরামত করা দরকার।
তাজমহল নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে জয়পুরের প্রাক্তন রাজপরিবারের সদস্য এবং রাজসমন্দের বিজেপি সাংসদ দিয়া কুমারী একটি চিত্তাকর্ষক দাবি করেছেন। দিয়া কুমারী বলেছেন, তাজমহল জয়পুর রাজপরিবারের সম্পত্তি এবং তৎকালীন মুঘল শাসক শাহজাহান সেটি অধিগ্রহণ করেছিলেন। সাংসদ বলেন, সে সময় দেশে মুঘলদের শাসন ছিল এবং এ নিয়ে কোনো আপিল শুনানি হয়নি।
সাংসদ দিয়া কুমারী তাজমহলের বন্ধ কক্ষ খোলার জন্য দায়ের করা আবেদনে খুশি প্রকাশ করে বলেন, ‘এমনটা করা উচিত, যাতে জানা যায় সেখানে কী ছিল। তাজমহল সম্পর্কিত সমস্ত নথি জয়পুরের প্রাক্তন রাজপরিবারের পুঁথি খানায় সুরক্ষিত রয়েছে এবং যদি কোনো আদালত এই নথিগুলি সরবরাহ করতে বলে তবে আমরা সেগুলি উপলব্ধ করব। আমরা এর জন্য প্রস্তুত।’
কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ বিতর্কের প্রাথমিক পর্বেই জল ঢেলে দিয়েছে।